nulibrary

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর ।

Reading Time: 1 minute

ভূমিকা : জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৯১৭ সালের বা ২৫ অক্টোবর এবং গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির অনুসারে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে সংঘটিত বিপ্লবকে র বলশেভিক বিপ্লব বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল এই বিপ্লব অক্টোবর অক্টোবর বিপ্লব নামেও পরিচিত। এই বু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম কারিগররা ছিলেন মেহনতি শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষেরা। অত্যাচারী জার শাসনের বিরুদ্ধে ১৯১৭ সালে মোট ৩টি বিপ্লব সংঘটিত হয় যার সর্বশেষটি ছিল বলশেভিক নামক দলটির নেতৃত্বে দলটির নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ে তোলে । পুঁজিবাদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করে রাশিয়াকে এক শিল্পোন্নত এবং সামাজিক সাম্যের দেশে রূপান্তরিত করে কেবল তাই নয়, বলশেভিক বিপ্লব রাশিয়া জাতিগত সমস্যারও সমাধান করেছিল। বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন বিপ্লব সম্পর্কে বলেন, “যে শ্রমিক ও কৃষক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা কথা বলশেভিকরা সর্বদা বলে এসেছে তা ঘটল।” বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমেই পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্ম হয়।

→ বলশেভিক বিপ্লবের কারণ : নিম্নে বলশেভিক বিপ্লবের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. কৃষকদের অসন্তোষ : তৎকালীন রাশিয়া ছিল কৃষিপ্ৰধান দেশ। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। রাশিয়ার কৃষিব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। তার উপর অতিরিক্ত করারোপ ও মধ্যস্বত্ব ভোগীদের অত্যাচারে কৃষকরা নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল । ফলে তাদের ভিতরে তীব্র অসন্তোষ জমা হতে থাকে।

২. ভূমিব্যবস্থা : জার শাসনামলে রাশিয়ায় সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা চালু ছিল। সমাজ ভূমিমালিক তথা জমিদার এবং ভূমিদার ই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। কৃষিজমির উপর ভূমিদাস তথা কৃষকের কোনো স্বত্ব বা মালিকানা কৃষকদের উপর অত্যাচার করতো। কখনো কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও খাজনা মওকুফ করা হতো না। ফলে এই অসম ও অন্যান্য ভূমি ব্যবস্থার কারণে সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের ভূমিমালিকদের প্রতি চরম অসন্তুষ্ট ছিল।

৩. বেকারত্ব : দুর্নীতিপরায়ণ জার শাসকের আমলে বেকারত্ব ভয়াবহ অধিকার ধারণ করেছিল। কারখানায় পুঁজিবাদী মালিক শ্রেণি। শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী একের পর এক নীতি গ্রহণ করতে থাকে। মুনাফা বৃদ্ধিই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে তারা শ্রমিক ছাঁটাই করা শুরু করে। যার ফলে প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। এসব বেকার শ্রমিকেরা পরবর্তীতে জার পতনের জন্য আন্দোলনে যোগ দেয় ৷

৪. কোলাক ও জমিদারদের অত্যাচার : সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তৎকালীন রাশিয়ায় ভূমি মালিক ও সার্ফ অর্থাৎ ভূমিদাস এই দুই শ্রেণি অবস্থান করতো। ভূমিমালিকেরা উৎপাদিত ফসল ও খাজনা আদায়ের জন্য বিভিন্ন লোক নিয়োগ করতো। এসব মধ্যস্বত্বভোগী খোলাক ও জমিদারগণ সাধারণ কৃষকদের নানাভাবে শাসন ও শোষণ করতো এবং বিভিন্ন উপায়ে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের জন্য অত্যাচার করতো । ফলে কৃষকেরা তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বলশেভিকের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে |

৫. জার সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি : জার সরকার ছিল রাশিয়ার সকল ক্ষমতার ও মর্যাদার উৎস এবং জার সরকার ছিল বুর্জোয়া ও অভিজাত শ্রেণি দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে যেকোনো ব্যাপারে জার বুর্জোয়াদেরই স্বার্থরক্ষা করতো। এতে যদি সাধারণ কৃষক শ্রমিক সম্প্রদায়ের জন্য অকল্যাণকর নীতি গ্রহণ করতে হতো জার সরকার তাতেও কুণ্ঠা বোধ করতো না। ফলে সাধারণ মানুষ জার সরকারের উপর ক্ষিপ্ত ছিল।

৬. দুর্নীতি : জার সরকারের প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মহামারি আকার ধারণ করে। কেননা প্রশাসনের সকল রাজকর্মচারী জার নিজে নিয়োগ দিতো। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে জারের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দই মূল যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত ছিল। ফলে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে প্রশাসন ছেয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব রাজকর্মচারীর দ্বারা জনগণের কল্যাণসাধন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

৭. জারের দমননীতি : জনবিচ্ছিন্ন জার সরকার নিজের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সর্বদা দমননীতি পালন করতো। জার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য জনগণকে সচেতন করতে অনেক গুপ্ত সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ঘটে। পরবর্তীতে এসব গুপ্ত সংগঠনকে দমন করতে জার সরকার দমনপীড়ন নীতি গ্রহণ করে। ১৯১৮ সালে সর্বপ্রথম একটি "Union of Pablic Good" নামে গুপ্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। যারাই জার সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তাদেরই দমন করা হয়েছে।

৮. পুঁজিবাদের উন্মেষ : যদিও তৎকালীন রাশিয়ার সামন্ত তান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তবে তখন পুঁজিবাদেরও বিকাশ ঘটেছিল। প্রায় অধিকাংশ কলকারখানায় মালিক ছিল এসব বুর্জোয়া শ্রেণির পুঁজিপতিরা সমাজের সকল উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদকের উপায়ের মালিকও ছিল এসব পুঁজিবাদিরা। ফলে সমাজের পুঁজি একটি নির্দিষ্ট মানুষের হাতে কুক্ষিগত ছিল এবং আরেকটি বিশাল সম্প্রদায় জীবনধারণের জন্য শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য ছিল। শ্রমিক শ্রেণিকে ইচ্ছামতো শোষণ করা হতো। ফলে শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠে|

বলশেভিক বিপ্লবের ফলাফল : বলশেভিক বিপ্লব মানব ইতিহাসের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই এর ফলাফলগুলোও ছিল তেমনই যুগান্তকারী।
৯. সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র : বলশেভিক বিপ্লবের সবচেয়ে বড় ফলাফল সামন্ততান্ত্রিক জার সরকার এবং বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদের পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা। এর ফলে রাশিয়ার রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। পুরোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে ফেলে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয় । জার শাসনামলের গঠিত সিনেট ভেঙে দেয়া হয় ।

১০. নতুন অর্থব্যবস্থা : সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদকের উপায় সবকিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়, এমনকি বণ্টন ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হয়। বিপ্লবের পরে সকল কলকারখানা ও ভূমি রাষ্ট্রীয় মালিকানার চলে যাওয়ার বুর্জোয়া শ্রেণির অবসান ঘটে। শ্রমিকের মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শোষণের পথও বন্ধ হয়ে যায় ।

১১. নতুন শাসনতন্ত্র : বিপ্লবের ফলে বলশেভিক দলের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করা হয়। রাশিয়ার ডুমা বা সংসদকে ভেঙে ফেলা হয়। রাশিয়ার যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বলশেভিক বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিল নতুন সরকার এসে সেগুলো ভেঙে দেয়। জার শাসনামলের সিনেট ভেঙে দেয়। জার প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও অনেক সংস্কার করা হয় ।

১২. বলশেভিক দলের ক্ষমতা গ্রহণ : অক্টোবর বিপ্লব বলশেভিক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়। দলটির নেতৃত্বে তৎকালীন রাশিয়ার ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক সকল সাধারণ মানুষ বিপ্লবে অংশ নেয় । ফলে প্রশাসনের শূন্যতা পূরণ করতে বলশেভিক দলটি ক্ষমতায় আসীন হয় । নবপ্রতিষ্ঠিত দলটির নেতৃত্ব ছিলেন ট্রটস্কি এবং লেনিন। তাদের হাত ধরে পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয় ।

১৩. নতুন পররাষ্ট্রনীতি : বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে আমূলে পরিবর্তন করা হয়। এর ফলে রাশিয়া পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে রাশিয়ার লালফৌজ এই যুদ্ধে সফলতা লাভ করলেও আন্তর্জাতিক নীতির কারণে কার্জন লাইন বরাবর যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা মেনে নিতে বাধ্য হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তুরস্কের সাথে আক্রমণ চুক্তি করে রাশিয়া ।

১৪. ধর্মনিরপেক্ষতা : সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর বলশেভিক সরকার অনেকগুলো ধর্মীয় সংস্কার সাধন করে। গির্জাকে রাষ্ট্রে থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। গির্জার অন্তর্গত সকল জমি রাষ্ট্রের মালিকানায় নেয়া হয়। নাগরিকের বিয়ে ও তালাকের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেয়া হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতামূলক রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় ৷

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে জার সরকারের শোষণের অবসান ঘটে নতুন এক রাশিয়ার জন্ম হয়। কার্ল মার্কসের দর্শনে উদ্বুদ্ধ লেনিন এক শোষণহীন ও সামাজিক ন্যায্যতা ও সমতার জন্য সমাজ গঠনে সামনে এগিয়ে যায় এবং লেনিন সমাজতন্ত্রের সকল নীতিকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে সবকিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানার অন্ত র্ভুক্ত করেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়া জারতন্ত্র থেকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। তিনি পরে নতুন শাসনতন্ত্র প্রদান করেন এবং বলশেভিক দলের নিজস্ব কর্মপন্থা ও দর্শন অনুযায়ী, সকল মানুষের মধ্যে সমতা স্থাপন, সকল জমি ও মূলধন রাষ্ট্রীয়করণ করে মানুষের জীবনের উন্নতি সাধন করেন।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram