nulibrary

১৯৪০ সালের সালের লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

Reading Time: 1 minute

অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তথা মুসলমানদের রাজনৈতিক অগ্রগতির ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে তার মধ্যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অন্যতম। এটি ছিল অনুন্নত মুসলমান সমাজের ভাগ্যোন্নয়নের এক অপূর্ব চাবিকাঠি। বিশেষ করে লাহোর প্রস্তাবেই মুসলমানরা সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধভাবে জোড়ালো কণ্ঠে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাস ভূমি তথা স্বাধীন স্বার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানান এবং তাদের এই স্বতন্ত্র চিন্তাধারা অন্য কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোকের জন্য হুমকিস্বরূপও ছিলনা। পরবর্তীতে লাহোর প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।

→ লাহোর প্রস্তাবের বিষয়বস্তু :

(ক) ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

(খ) এসব অঞ্চলকে প্রয়োজন মতো সীমা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে ভারতবর্ষে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যেসব স্থানে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সে অঞ্চলসমূহে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় ।

(গ) স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম ।

প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, “নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ → অধিবেশনের সুনিশ্চিত অভিমত এই যে, কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা ন এদেশে কার্যকর করা যাবে না বা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি তা নিম্নরূপ মূলনীতির উপর পরিকল্পিত না হয় ।

দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয় : “এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের র ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ-সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথোপযুক্ত | কার্যকরি ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে করতে B হবে। ভারতবর্ষে মুসলমানগণ যেসব স্থানে সংখ্যালঘু সেসব স্থানে তাদেরও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, T শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ-সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথোপযুক্ত কার্যকরি ও বাধ্যতামুলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্র করতে হবে।”

→ লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব : ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সকল দিক থেকে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা লাহোর প্রস্তাব পরবর্তীতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। । নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. রাজনীতিতে নতুন ধারা : ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে। এতদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দুটি রাজনৈতিক দল থাকলেও সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হত এক পক্ষীয়ভাবে । কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতি সমানভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । যার ফলে রাজনীতি নতুনভাবে অগ্রসর হয়।

২. মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি : লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলিম ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এতদিন হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পর মিলে-মিশে চলত এবং নিজেদেরকে একই জাতীয়তাবোধের অধীন বলে মনে করত। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলিম ঐক্যবোধের সূত্রে আবদ্ধ হয় এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ তৈরি করে ।

৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : লাহোর প্রস্তাবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পায়। এতদিন অনেক মুসলমান ও কংগ্রেসের অধীনস্ত ছিল কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানদের নিকট কংগ্রেস হিন্দুদের দল এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে সকল মুসলমানই মুসলিম লীগের ছায়াতলে আসন নেয় ৷

৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের প্রভাব : ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে লাহোর প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ মোট ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮ টি আসন লাভ করে। অথচ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের আগে মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাত্র ১

৫. ভারত স্বাধীনতা আইন পাস : লাহোর প্রস্তাবের ফলে এশিয়ার ইতিহাস হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থগত চরমাকারে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। এরূপ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করতে পায় যে, ভারতবর্ষের বিভক্তি ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কোন পথ নেই। তাই লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করা হয়।

৬. পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম : সকল বন্ধন ছিন্ন করে ও সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যার ফলে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তব রূপ লাভ করে । মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রতা লাভ করে ।

৭. নবদিগন্তের সূচনা : ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব এক নবদিগন্তের সূচনা করে। কেননা এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ভারতবর্ষ তার হাজার বছরের ইতিহাস ছিন্ন করে বিভক্ত হয়ে পড়ে আর ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় ।

৮. স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন : আজকে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বসবাস করছি তারও স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয় ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে। কেননা লাহোর প্রস্তাবে যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয় পরবর্তীতে স্বাধীন পাকিস্তানে বাঙালিরা তারই ভিত্তিতে আন্দোলন করে এবং এই ভিত্তিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাভ করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ।

৯. স্বাধীন বাংলার বীজ বপন : লাহোর প্রস্তাবই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বাপন করেছিল । কেননা লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে পরবর্তীকালে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একাধিক জায়গায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয় । কিন্তু বাংলার মুসলমানরা সর্বদাই লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন করতে থাকে । নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা হয় বাংলার স্বাধীনতা আনেকাংশে লাহোর প্রস্তাবেরই ফল।

→ লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল অলোচনা করা হলো :

১. মুসলিম প্রতিক্রিয়া : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্বে কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারের সাথে আপোষ ও অনুগত্যের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলমানদের ধ্যান ধারণার মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। মুসলমানরা এখান থেকেই অনুভব করেন যে তাদের সাংবিধানিক নিরাপত্তার দরকার নেই। তারা সাংবিধানিক নিরাপত্তার পরিবর্তে পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্বের দাবি জানায় ।০৯টি আসন লাভ করে।

লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ অভূতপূর্ব সাফলতা লাভ করে। তারা ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮টি আসন লাভ করে এবং এই নির্বাচনের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসেবে পালন করে। এককথায় মুসলমানরা মনেপ্রাণে নিজস্ব রাষ্ট্রের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে

২. হিন্দু প্রতিক্রিয়া : হিন্দুদের জন্য লাহোর প্রস্তাব নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে। কেননা হিন্দুরা লাহোর প্রস্তাবকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। গান্ধীজী মনে করেন লাহোর প্রস্তাব মেনে নিলে ভারতকে ব্যবচ্ছেদ করা হবে যা অত্যন্ত পাপের কাজ।

জওহরলাল নেহেরু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “লাহোর প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত হয়ে পড়বে বলবান রাষ্ট্রগুলোর ন্যায় ছোট ছোট কর্তৃত্ববাদী পুলিশ রাষ্ট্র” । মুসলিম লীগ প্রস্তাবগুলো এই প্রস্তাবকে “পাকিস্তান প্রস্তাব” বলে সমালোচনা করেন। এক কথায় হিন্দুরা লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালান ।

৩. ভারতের বিভক্তি : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় ভারত বিভক্তির পথ অনেকটাই সুগম হয়ে যায়। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মূলত অখণ্ড ভারতের জন্য যৌথভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে ছিলেন। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে তার ছেদ পড়ে। ব্রিটিশ সরকার ও লাহোর প্রস্তাবের ফলে উপলব্ধি করেন যে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের কে একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় রাখা হবে নির্বুদ্ধিতার শামিল। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব অখণ্ড ভারতের ধারণায় ব্যবচ্ছেদ ঘটায়।

৪. হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট : যদিও ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মৌলিক। তবুও হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ ভাবে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন পরিচালনা করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে অসামান্য। এই প্রস্তাব আন্দোলনরত মুসলমান জাতির মধ্যে এক নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। তাই বলা যায় যদি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত না হতো তাহলে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্র শুধু কল্পনাই থেকে যেত ।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram