nulibrary

১৯১৭ সালের অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঘটনা বিশ্লেষণ কর ।

Reading Time: 1 minute

ভূমিকা : কোনো বিপ্লবই নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের ঘটনা নয়, বরং অনেক সময় এবং শ্রমের পরে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং প্রতিটি বিপ্লবই হলো অত্যন্ত ঘটনাবহুল। তবে রুশ বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাগুলো আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। কেননা এই বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শোষণ বৈষম্যের যন্ত্রণায় আর্তনাদরত অমানবিক সমাজব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করা এবং শত শত বছরের শোষণের সমাজব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী জার শাসকরে বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া এই বিপ্লব ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামাজিক বিপ্লব। সাম্যভিত্তিক মানবিক সমাজের যে স্বপ্ন মানুষ যুগ যুগ ধরে লালন করে আসছিল তার রূপায়নই ছিল এই বিপ্লবের লক্ষ্য ।

অক্টোবর বিপ্লবের ধারণা : যদিও জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়। কিন্তু এই বিপ্লবের পূর্বের আরো ২টি বিপ্লবের ধারাবাহিকতা ছিল রুশ বিপ্লব। তাই বলা যায়, অক্টোবর বিপ্লব শুরু হয় মূলত ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই। নিম্নে অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাবলি বর্ণনা দেয়া হলো :

১. মার্চ/ফেব্রুয়ারি বিপ্লব : ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জার দ্বিতীয় গয়া নিকোলাসকে বিদ্রোহী সৈন্যরা পদত্যাগ করতে বাধ্য করে এর আগে এই পলাতক জারের ট্রেন-রেল শ্রমিকরা মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল। ইন অনেক লোমহর্ষক ঘটনার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার জার সরকারের পতন ঘটে। তারপর প্রথমে লভোভ এবং পরে কেরেনস্কি-এর নেতৃত্বে পর মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। এই মন্ত্রিসভার বুর্জোয়া দল । কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরাই সর্বেসর্বা ছিল। তাই লেনিন একে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলেছেন।

২. জুলাই-এর ঘটনা : বুর্জোয়া সরকার ১৯১৭ সালের ১৮ জুন জার্মানির বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনা করে দক্ষিণ রাশিয়ার গ্যালিসিয়া উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু রাশিয়ার এ অভিযান র ব্যর্থ হয় এবং প্রায় ৬০,০০০ সৈনিক হতাহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেশিনগান রেজিমেন্টের সৈন্যরা ২ জুলাই শ্রমিকদের সাথে নিয়ে একটি অভিযানের পরিচালনা করে এবং তা ব্যর্থ হয়। লেনিন যদিও নিজেকে এবং শ্রমিকদেরকে এ ব্যাপারে থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু ৫ লক্ষ উত্তেজিত শ্রমিক ও সৈনিক ৪ জুলাই পেট্রোগ্রাদে বিক্ষোভ করে এবং সরকারি বাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালায়। বলশেভিকদের অফিস ভেঙে দেয় ও গ্রেফতার করে। লেনিনকে জার্মানের চর বলা হয় এবং হত্যার চেষ্টা করলো । এই ঘটনাটি রুশ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।

৩. লেনিনের কর্তৃত্ব গ্রহণ : ১৯০৫ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন এবং আলেকজান্ডার বগদানভ বলশেভিক দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলটি ছিল সংগঠিত শ্রমিক গোষ্ঠী। যা কিনা কেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। এই দলটির সদস্যের কর্মীরা নিজেদের রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির নেতা বলে দাবি করতো। রুশ বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় তিনি দেশে ছিলেন না। পরবর্তীতে তিনি দেশে ফিরে ১৯১৭ সালের ৭ অক্টোবর ফিনল্যান্ডে থেকে ফিরে এসে রাশিয়ার বিপ্লবের নেতৃত্ব নেন।

৪. অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি : লেনিন ১০ অক্টোবর বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি গোপন বৈঠক বসান। সেই বৈঠকে তিনি একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সবাইকে অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি স্বরূপ বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি, পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েত, ট্রেড ইউনিয়নগুলো বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের কমিটি, সেনা ও সৈন্যবাহিনী থেকে লোকজন নিয়ে বিপ্লবী সাময়িক কমিটি গঠন করা হয়।

৫. প্রতিনিধি নিয়োগ : লেনিন সাময়িক কমিটি গঠন করার পর কমিটির বিভিন্ন কার্যাবলি পরিচালনা করার জন্য স্ট্যালিন, সাদলভ, বনাজিনস্কি কুবনভ আর উরিটস্কিকে নিয়োগ দেন। এসব ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব ছিল সাময়িক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি সূচারুরূপে সম্পন্ন করা। লেনিন নিজে সকলের সাথে বৈঠক ডেকে অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি ও কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতেন যাতে অভ্যুত্থানে সফল হয় ।

৬. অভ্যুত্থানের তথ্য ফাঁস : বলশেভিক পার্টির একটি বর্ধিত সভায় ১৬ অক্টোবর লেনিন অভ্যুত্থানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা | বিপ্লব ছিল করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম ২ জন বিপ্লবের সদস্য কামেনভ ও জিনেভিয়েভ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেন। বিপক্ষে তবে তারা কেবল বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং কেরনস্কির কাছ পেট্রোগ্রা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সকল গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয় যা পরে | এগুলোে পত্রিকায় প্রকাশ হয়। এতে অস্থায়ী সরকার অভ্যুত্থানে মোকাবেলা করার জন্য পেট্রোগ্রাদ ও মস্কোতে সাময়িক শক্তি জড়ো করে ।

৭. অভ্যুত্থানের ১ম পর্ব : নতুন ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী ৬ নভেম্বর সকালবেলা (২৪ অক্টোবর জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) লেনিনের নির্দেশানুযায়ী লালফৌজ ও বিপ্লবী সেনারা রেলস্টেশন, ডাকঘর, তারঘর, পার্লামেন্ট ভবন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ভবনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে দেয়। এভাবেই পেট্রোগ্রাদের স্মোলনি বালিকা ইনস্টিটিউটকে প্রধান ঘাঁটি করে অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়।

৮. অভ্যূত্থানের ২য় পর্ব : জারের নীতি প্রাসাদ তথা কেরেনস্কি সরকারের প্রধান কর্মস্থলকে লক্ষ করে যুদ্ধজাহাজ আরোরাতে কামান আগেই বসানো ছিল। সেদিন সকাল নাগাদ অস্থায়ী সরকারের সকল সৈনিকদের প্রতিরোধে চূর্ণ করা হয়। রাত ৯.৪৫ নাগাদ জাহাজ আরোরা থেকে প্রাসাদে কামাল দাগা শুরু হয়। বলশেভিকরা শীত প্রাসাদ দখল করে মন্ত্রীদের প্রলে গ্রেফতার করে। তাদের পিটারপল দুর্গে আটকে রাখা হয়। কেরেনস্কি ও তার সহযোগীরা পালিয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে সামান্য রক্তপাতের মাধ্যমেই এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।

৯. সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব : পৃথিবীর যেকোনো বিপ্লবই মানু অনেক রক্তের মাধ্যমে সফল হয়। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের অন্যতম নিয়ামক আন্দোলন বলশেভিক আন্দোলনে খুবই সামান্য পৃথি রক্তপাত হয়েছিল। কেননা এটা ছিল গণমানুষের বিপ্লব। রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষই বিপ্লবের অংশ নিয়েছিল এবং জার বির সকল রথী-মহারথীরা পালিয়ে যায়। বুর্জোয়া সরকারের মন্ত্রীদের অব আটক করে পিটবুল দুর্গে রাখা হয়। তাই তেমন একটা প্রতিরোধ । মা ছাড়াই লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয় ।

১০. পুঁজিবাদের পতন : অক্টোবর বিপ্লব ছিল পুঁজিবাদের কিন্তু বিরুদ্ধে। কেননা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে জার শাসনের অবসানের পর সকলে ভেবেছিল যে সমাজে ন্যায় ও সাম্যের প্রতিষ্ঠা হবে। শাসন ক্ষমতা জারের হাত থেকে অভিজাত ও বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে যায়। এই বুর্জোয়ারা বলতে গেলে জার সরকারেরই অন্যরূপ ছিল। ফলে জনগণের কোনো লাভ হয়নি, বরং এই সরকার পুঁজিবাদের বিকাশে অনেক ভূমিকা রাখছিল। তাই লেনিন এই সামরিক ও পুঁজিবাদী সরকারের পতনের জন্য আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং অবশেষে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে।

১১. বলশেভিক দলের ক্ষমতা গ্রহণ : অক্টোবর বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লবের পর জার শাসকের পুরোপুরি পতন ঘটে। এতে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা কার হাতে যাবে এই প্রশ্ন উঠে । স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বদানকারী বলশেভিক দলই ক্ষমতা গ্রহণ করেন অর্থাৎ লেনিন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই লেনিন রাষ্ট্র পরিচালনায় মন দিতে পারেননি।

১২. প্রতিবিপ্লবীদের দমন : যদিও অক্টোবর বিপ্লব গণমানুষের বিপ্লব ছিল তার মানে এই না যে রাশিয়ার সব মানুষই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষপাতি ছিল। যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিপ্লবের বিপক্ষে ছিল তারা প্রতিবিপ্লব করার চেষ্টা করলো। যেমন মস্কো ও পেট্রোগ্রাদের পৌরসভাগুলো বিপ্লবের বিপক্ষে ছিল বলে লেনিন এগুলোকে ভেঙে দেন। লেনিনকে বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবীদের দমন করার প্রতি মনোযোগ দিতে হয়।

১৩. প্রজাতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা : মহান অক্টোবর বিপ্লবের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল জার শাসনের ও বুর্জোয়া শাসনের অবসান ঘটিয়ে মজলুম সাধারণ কৃষক শ্রমিক তথা প্রলেতারিয়েতদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। লেনিন তাই বুর্জোয়া ও অভিজাতদের সংসদ ডুমা ভেঙে দেন। পুরোনো প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে একটি নতুন রাশিয়ার জন্ম দেন। যার নাম হয় প্রজাতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া।

১৪. অক্টোবর বিপ্লবের প্রকৃতি : অক্টোবর বিপ্লব ছিল পৃথিবীর অন্যতম সফল বিপ্লব। প্রকৃতগত দিক থেকে এটি ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। লেনিন এই আন্দোলনের গড়ে তোলেন যাতে রাশিয়ার সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের অবসান টানে । যাতে মজলুম, শোষিত, বঞ্চিত সাধারণ কৃষক শ্রমিক তথা প্রলেতারিয়েতদের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। সকল ভূমি ও কলকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে যায়। সকল ধরনের উপাদনের উপকরণ ও উৎপাদনের উপায় এবং বণ্টন ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেয়া হয়। যাতে সমাজে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা পায় ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, অক্টোবর বিপ্লব ছিল এই পৃথিবীর জন্য এক নতুন সমাজব্যবস্থার দ্বার উন্মোচনের বিপ্লব। এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই বিপ্লব ছিল সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে । এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জার ও বুর্জোয়া ঈশ্বরতন্ত্রের অবসান ঘটে। মূলত ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের জার শাসনের পতনের মাধ্যমইে অক্টোবর বিপ্লবের বীজ বোনা হয়ে যায় ।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram