nulibrary

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা কর।

Reading Time: 1 minute

ভূমিকা : ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ায় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। আর এই নবগঠিত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত সচেতনতার সাথে গ্রহণ করা হয়। সে সময়কার পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে সোভিয়েতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়। সোভিয়েতের পররাষ্ট্রনীতি কয়েকটি পর্যায়ে আলোচনার করা হয়। আমরা এখানে সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতির তিনটি পর্যায় তুলে ধরব।

নিয়ে সোভিয়েতের পররাষ্ট্রনীতির পর্যায়গুলো তুলে ধরা হলো : প্রথম পর্যায় : পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতাকে প্রতিহত করতে সোভিয়েত সরকার যেসব নীতি প্রয়োগ করে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো :

প্রথমত, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চলাকালে বলশেভিক পার্টির নেতা ভি.আই. লেনিন বিশ্বযুদ্ধকে জারের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন। বিপ্লবের পর ক্ষমতাসীন হয়ে লেনিন ঘোষণা দেন যে, বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা তার সাম্যবাদী আদর্শের পরিপন্থি এবং রাশিয়া এ যুদ্ধে জড়িত থাকলে বলশেভিক বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাবে। এজন্য লেনিন ক্ষমতায় এসেই রাশিয়াকে বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেয়। যুদ্ধমান দেশগুলোকে চুক্তির মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের আবেদন জানায়। কিন্তু মিত্রপক্ষের কেউ এতে সাড়া দেয়নি। উপরন্তু রাশিয়ার মিত্রপক্ষ থেকে সরে যাওয়ায় মিত্রশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাশিয়ার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ফলে এদেশগুলো মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

দ্বিতীয়ত, ১৯১৭ সালে যুদ্ধ চলার সময়ে রাশিয়ার সীমান্তে জার্মান সেনার একটি বিরাট বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ শান্তির ক্ষেত্রে এটা এক ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। তাই নতুন সোভিয়েত জার্মানির সাথে মৈত্রী স্থাপনে উদ্যোগী হয় । বিপ্লব পরবর্তী নব গঠিত সোভিয়েত রাশিয়ার টিকে থাকার জন্য অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা জরুরি ছিল।

তৃতীয়ত, বলশেভিক সরকার যখন ক্ষমতা দখল করে, সেসময় রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। যুদ্ধে প্রচুর অর্থ ও জনবল নিয়োগের কারণে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসে। এমতাবস্থায় বলশেভিক সরকার জার আমলে গৃহীত সকল বৈদেশিক ঋণ ও চুক্তি অস্বীকার করে। তারা জানায় জার কর্তৃক গ্রহীত ঋণ জার পরিশোধ করবে, জনগণ নয়। এতে পশ্চিমা শক্তি তথা মিত্রপক্ষ বলশেভিক সরকারের উপর ক্ষুব্ধ হয় ।

চতুর্থত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগে রাশিয়া সরকার তার আরেক উদ্দেশ্য পূরণের উদ্যোগ নেয়, আর তা হলো বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধ্বংস করে বিশ্বে সাম্যবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। রাশিয়া তার সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। ১৯১৯-২০ সালের দিকে রাশিয়ার সমর্থনে জার্মানির ব্যাভেরিয়া এবং হাঙ্গেরিতে সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ঘটে ও পরে তা ব্যর্থ হয়। এরপর ফ্রান্স ও ব্রিটেনে বিপ্লবের চেষ্টা করেও রাশিয়া ব্যর্থ হয় ।

দ্বিতীয় পর্যায় : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগে সোভিয়েত রাশিয়া নিজের অবস্থানকে শক্ত করার জন্য ইউরোপের মধ্যে তার সাম্যবাদী আদর্শ প্রচারের চেষ্টা করে। যার ফলে ইউরোপীয় সমগ্র শক্তি একযোগে রাশিয়ার উপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং সাভিয়েত সরকারকে উৎখাত করতে রাশিয়ার বিপ্লব বিরোধী বাহিনীকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় । ফলে সোভিয়েত সরকার দ্বৈত সমস্যার মুখোমুখি হয়। রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার কারণে অর্থাৎ পশ্চিমাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন রাশিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ছিল পশ্চিমাদের জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ১৯২২ সালের ১৫ এপ্রিল রাশিয়া ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী র‍্যাপেলো চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির মাধ্যমে দুই ভার্সাই চুক্তি বিরোধী শক্তি জোটবদ্ধ হয়।

বলশেভিক সরকার ঘোষণা দেয় যে রাষ্ট্র রাশিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান করবে সে রাষ্ট্রকে রাশিয়া রাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করবে। ১৯২৪ সালে নির্বাচনে জয়ী ব্রিটেনের লেবার পার্টি সোভিয়েত সরকাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর ফ্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপের আরো ৯টি দেশ রাশিয়াকে স্বীকৃতি দেয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকার করে। ১৯২৪ সালে লেনিন দেহত্যাগ করলে রাশিয়ার ক্ষমতায় আসেন আর এক কিংবদন্তী যোসেফ স্ট্যালিন। স্ট্যালিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ট্রটস্কির মধ্যে সাম্যবাদ প্রয়োগ প্রশ্নে মতানৈক্য দেখা দেয়। এরই মধ্যে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বুলগেরিয়ার কমিউনিস্টরা গণঅভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। সোভিয়েতের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটেনের শ্রমিকরা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। ব্রিটেনের শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘটে রাশিয়ার শ্রমিকদের হাত ছিল, এই অজুহাতে ব্রিটেন রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ক্রমে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের সাথেও রাশিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন হয়।

তৃতীয় পর্যায় : ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পর সোভিয়েত রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয়। এই পর্যায়ে এসে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল নিজেকে রক্ষা করা। সোভিয়েত ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি সমর্থন করেনি, কারণ এর ফলে তার পশ্চিমের এলাকাগুলো সোভিয়েতের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের উত্থান, দূরপ্রাচ্য জাপানের আগ্রাসন এবং হিটলারের পূর্ব ইউরোপের দিকে অভিয়ানের ঘোষণা এসব কারণে সোভিয়েত সরকার এই সময়ে ভার্সাই চুক্তি মেনে নেয়। কারণ এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার উপর জার্মানির আগ্রাসন নীতি প্রতিহত করার সম্ভাবনা ছিল ।

রাশিয়া ও ফ্রান্স- এই দুই হিটলার বিরোধী রাষ্ট্র নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে ১৯৩৫ সালে একটি অনাক্রমণ চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্স ও রাশিয়া তৃতীয় কোনো শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে পরস্পরের সহযোগিতা করবে প্রতিশ্রুতি দেয়। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হলে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সাথে রাশিয়ার সমঝোতামূলক সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে সোভিয়েতের সাথে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সমঝোতা সম্পর্কে অবনতি হতে থাকে। কারণ--

১. ব্রিটেনের টোরী সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘোর বিরোধী ছিল।
২. ভার্সাই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে জার্মানি তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকলে পশ্চিমা শক্তি ফ্রান্স ও ব্রিটেন জার্মানিকে কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।
৩. ১৯৩৬ সালে হিটলারের জার্মানি ও মুসোলিনির ইতালি চুক্তির মাধ্যমে অক্ষয় শক্তি বা জোট গঠন করে। ফলে রাশিয়ার পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্ত হুমকির মুখে পড়ে।
৪. ১৯৩৮ সালে হিটলার অস্ট্রিয়াকে দখল করে জার্মানির সাথে যুক্ত করলেও কোনো উদ্যোগ না নিয়ে জার্মানির কোষণ করে চলছিল।
৫. জার্মানি চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল দাবি করে এবং যুদ্ধের হুমকি দেয়। এর ফলে ফ্রান্স-রাশিয়ার চুক্তি মোতাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার নিরাপত্তার জন্য ফ্রান্স ও রাশিয়া যৌথভাবে জার্মানিকে বাধা দেয়ার কথা। কিন্তু ফ্রান্স তা করতে অস্বীকৃতি জানায় ।
৬. হিটলারের আগ্রাসী কার্যক্রমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তোষণনীতির আশ্রয় নেয়। যাতে পুরো চেকোস্লোভাকিয়াকে জার্মানি দখল করে নেয়। এর ফলে জার্মানির সীমান্ত রাশিয়ার সীমান্তের কাছে চলে আসে। অর্থাৎ রাশিয়ায় জার্মানির আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়

উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণে রাশিয়া বুঝতে পারে জার্মানির আক্রমণের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অনাগ্রহী। পুঁজিবাদী জার্মানির মাধ্যমে তারা রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চায়। যাতে রাশিয়া পশ্চিমাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার আশা ত্যাগ করে সম্পর্ক ছিন্ন করে ।

উপসংহার : পরিশেষে আলোচনা করা যায় যে, ১৯১৯-১৯৩৯ সালের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জোট চুক্তি ও মৈত্রী স্থাপিত হয়। হিটলারের উত্থানও আগ্রাসী নীতি থেকে রক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমাদের সাথে জোট গঠনে ব্যর্থ হলেও শেষ পর্যন্ত জার্মান-রুশ অনাক্রণ চুক্তির মাধ্যমে নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সফল হয় ।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram