“এপ্রিল থিসিস” এর মুল বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা কর।

Reading Time: 1 minute

ভূমিকা : রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম মহানায়ক হলো লেনিন। তার নেতৃত্বেই রাশিয়ার সমাজতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি ছিল 'এপ্রিল থিসিস'। ১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল লেনিন এই বিখ্যাত থিসিসটি জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। আর এই এপ্রিল থিসিসের মাধ্যমেই তৎকালীন বলশেভিক দল বিপ্লব সংক্রান্ত সকল করণীয় ও দিক- নির্দেশনা খুঁজে পেয়েছিল। কারণ এপ্রিল থিসিস ছিল লেনিনের বিপ্লবকেন্দ্রিক কর্মপরিকল্পনার। এটি ছিল রুশদের জন্য একটি চরম পত্র যার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ মুক্তির পথ নির্দেশিকা খুঁজে পেয়েছিল। এপ্রিল থিসিস প্রকাশ করার পর লেনিনের অনুসারীও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল । যার ফলে বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়।

এপ্রিল থিসিস : ১৯১৭ সালের এপ্রিলে বলশেভিকদের এক সভার লেনিন পার্টির নেতাদের উপস্থিতিতে একটি থিসিস পেশ করেন। এ থিসিসকে এপ্রিল থিসিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ৷ পেট্রোগ্রাদের তোরিদা কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হলেও এর তিন দিন পর প্রাভদা সভার এটি প্রকাশিত হয়। মূলত এপ্রিল থিসিসটি ছিল দলের সাধারণ কর্মীদের প্রতি একটি দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য যার মাধ্যমে সবাই বিপ্লবের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়।

→ এপ্রিল থিসিসের মূল বক্তব্য : লেনিন কর্তৃক প্রদত্ত এপ্রিল থিসিসের প্রধান দিকগুলো এখানে আলোচনা করা হলো :

১. বিপ্লবের প্রথম পর্ব : লেনিন তার থিসিসের মধ্যে বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের প্রথম পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু তিনি এটা বলেও সতর্ক করেন যে প্রথম পর্বে প্রলেতারিয়েতদের জন্য কোনো স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হবে না। প্রলেতারিয়েতদের কোনো প্রতিষ্ঠানিক সংগঠন না থাকায় বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা চলে গিয়েছে। বিপ্লব সফল করার জন্য প্রলেতারিয়েতদের একতাবদ্ধ হতে হবে।

২. বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্ব : বিপ্লবের প্রথম পর্ব বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। যার ফলে বিপ্লবের সকল রকম সুবিধা নেয়া শুরু করে। ফলে প্রলেতারিয়েতদের জন্য বিপ্লব এক প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এখন এ পর্বে কৃষক শ্রমিক ও মিত্র প্রলেতারিয়েতদের হাতে ক্ষমতা আসতে হবে। যাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফল মজলুম জনগণ পেতে পারে ।

৩. সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়া : ১ম বিপ্লবের পর রাশিয়ার সংসদীয় পদ্ধতির অস্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। লেনিন তার এপ্রিল থিসিসে যুক্তি দিয়ে এটা প্রমাণ করতে চলে যে, প্রথম বিপ্লবের পরে সংসদীয় পদ্ধতির অস্থায়ী সরকার থেকে সোভিয়েত এর ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে।

৪. সংসদীয় প্রজাতন্ত্রে নিষ্প্রয়োজন : লেনিনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করা। কেননা একমাত্র সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই সমাজে ন্যায় ও সাম্যতা প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। আর তাই বলশেভিক পার্টি কোনো প্রকারে বুর্জোয়া ও গণতান্ত্রিক সরকারকে বিশ্বাস করতে পারে না। কেননা এসব পদ্ধতিতে সরকার করতে পারে না। কেননা পদ্ধতিতে সরকার প্রলেতারিয়েত শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে না। তাই সংসদীয় প্রজাতন্ত্র সমাজের জন্য নিষ্প্রয়োজন ।

৫. তাৎক্ষণিক সরকার উচ্ছেদ করা যাবে না : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর গঠিত সংসদীয় পদ্ধতির বুর্জোয়া সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্ছেদ করার পক্ষপাতি ছিল সবাই। কিন্তু লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন যে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারকে উচ্ছেদ করতে গেলে কেবল রক্তক্ষয়ই হবে, এছাড়া কোনো লাভ হবে না। তাই থিসিসের এই পর্যায়ে এসে লেনিন বলেন, একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে তাৎক্ষণিক উচ্ছেদের চিন্তা করা সহজ নয়, আর বুর্জোয়া সরকার সাময়িক বাহিনীর সহায়তার ক্ষমতায় এসেছে এটাও মাথায় রাখা দরকার।

৬. জনসচেতনতা তৈরি করা : লেনিন মনে করতেন বুর্জোয়া সরকারকে উচ্ছেদ করতে চাওয়ার চেয়ে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতনর করে তোলা উচিত। কেননা এতে দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে। কারণ ফেব্রুয়ারির বিপ্লবের পর ক্ষমতায় বসা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আছে এমনকি কৃষক শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত সোভিয়েতগুলো ও বুর্জোয়া সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছে।

৭. চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা : যেকোনো বিপ্লব শুরু করার জন্য প্রথমে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর গঠিত বুর্জোয়া সরকারের প্রতি সকল শ্রেণি পেশার মানুষের আস্থা ছিল এবং সোভিয়েতগুলোর সমর্থন ছিল তখন বিপ্লব করার চেয়ে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করাই উত্তম হবে। তাই লেনিন বলেন, একটি বুর্জোয়া বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়। সুতরাং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা থাকা পর্যন্ত বিপ্লব সংঘটিত হবে না, বরং অপেক্ষা করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে। আর এভাবে চূড়ান্ত মুহূর্তে বিপ্লব শুরু করতে হবে।

৮. শান্তিচুক্তি : যেকোনো বিপ্লবের পরেই প্রতিবিপ্লবীদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। তাছাড়া বিশ্বযুদ্ধের কারণে যুদ্ধের প্রথম দশ মাসিইে রাশিয়ার প্রতি মাসে গড়ে তিন লাখ সৈনিক নিহত, আহত বা বন্দি হয়। ১৯১৭ পর্যন্ত রাশিয়ার গড় মাসিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল মৃত ৪০,০০০ আহত ১,২০,০০০ এবং বন্দি বা নিখোঁজ ছিল ৬০,০০০। তাই রুশ সেনাবাহিনীর মধ্যে এবং দেশের ভিতরে কৃষক শ্রমিকদের মধ্যে তাই যুদ্ধ থামানোর ইচ্ছা ছিল প্রবল। তাই লেনিন তার থিসিসে উল্লেখ করেন যে, সোভিয়েতগুলো যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিচুক্তি করা হবে।

৯. সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা : লেনিন তার এপ্রিল থিসিসে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার রূপরেখা প্রদান করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ফলে সকল জমি এবং কলকারখানাগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেয়া হবে। অর্থাৎ সকল ধরনের উৎপাদনের উপকরণ এবং উৎপাদনের উপায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হবে এবং বণ্টন ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে নেয়া হবে। যাতে সমাজের কোনো বুর্জোয়া শ্রেণির অস্তিত্ব না থাকে ।

→ এপ্রিল থিসিসের গুরুত্ব : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় লেনিন দেশে ছিলেন না। এপ্রিল মাসে দেশে ফিরে তিনি এই থিসিসটি দেন যার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

১. বিপ্লবের পথনির্দেশনা : লেনিন যেহেতু ফেব্রুয়ারির বিপ্লবের সময় দেশে ছিলেন না এবং বিপ্লবের পর একটি অভিজাত ও বুর্জোয়া শ্রেণি দ্বারা গঠিত সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় যারা সাধারণ মানুষ নয়; বরং বুর্জোয়াদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করা শুরু করে তাই লেনিন এপ্রিল থিসিসটি প্রদান করেন। যাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী দল দিক-নির্দেশনা পায়। এবং এর মাধ্যমেই পরবর্তীতে বলশেভিক বিপ্লব সাধন করা হয়।

২. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার : বলশেভিক বিপ্লবে পূর্বে রাশিয়া ভাষা, ধর্ম, জাতি ইত্যাদির ভিত্তিতে চরম বৈষম্য করা হতো। রুশভাষীরা অরুশভাষীদেরকে অবজ্ঞা করতো। তাই লেনিন ঘোষণা দেন যে, এপ্রিল থিসিসের মাধ্যমে সবাইকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সুযোগ দেয়া হবে। কাউকে ভাষা বা ধর্মের জন্য বৈষম্য করা হবে না এবং সব মানুষ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।

৩. শ্রমিকদের একতা : জার শাসনামলে কৃষক-শ্রমিকদের। কোনো মূল্যেই দেয়া হতো না। তার উপর তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচার করা হতো। যার ফলে এক সময় কৃষক ও শ্রমিকেরা বিদ্রোহ করে। কিন্তু তারা কেউই এক্যবদ্ধ ছিলেন না। ফলে তাদের আন্দোলন ও ফলপ্রসূ ছিল। না। এই কারণে লেনিন তার এপ্রিল থিসিসে বার বার কৃষক শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে জোর দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে বলশেভিক বিপ্লব সফল হয়।

৪. বুর্জোয়াদের পতন : লেনিনের এপ্রিল থিসিসের অন্যতম গুরুত্ব ছিল বুর্জোয়াদের পতনের জন্য। কেননা সবার উদ্দেশ্য ছিল জার শাসনামলের পতন ঘটিয়ে গণমানুষের মুক্তি ঘটবে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর জার শাসনামলের অবসান ঘটেছিল বটে কিন্তু বুর্জোয়া ও অভিজাতরাই সরকার গঠন করে। যদিও সেই সরকার গণতন্ত্রপন্থি ছিল কিন্তু তাদের দ্বারা সাধারণ কৃষক শ্রমিকদের কষ্ট অনুধারণ করা সম্ভব না, বরং এতে আরেকটি শোষণের পথই চালু হয়েছে। তাই তিনি এপ্রিল থিসিসের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের পতনের ঘোষণা দেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন ১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল থিসিস প্রদান করেন যা ছিল মূলত বলশেভিক একটি রূপরেখা ছিল। এই রূপরেখার কারণেই পরবর্তীতে একটি সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়। যখন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এক ধরনের নেতৃত্বহীনতায় ভুগছিল সেই মুহূর্তে লেনিন দিক-নিদের্শনামূলক এপ্রিল থিসিসটি প্রদান করেন। তার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটানো এবং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা। এপ্রিল থিসিসের মাধ্যমে তিনি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান এবং অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সকল বৈষম্যের অবসান ঘটান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.

You may find almost every type of National University information here, including NU news, NU admissions information, NU results, and NU exam schedules.
Our goal is to aid NU students by offering information.
© Copyright 2022 - aowlad - All Rights Reserved
magnifierchevron-down linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram