nulibrary

ভূমিকা : রাশিয়ায় সংঘটিত দুই বিপ্লবের মধ্যে অন্যতম একটি বিপ্লব হলো ১৯১৭ সালে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। এই বিপ্লব যদি পেট্রোগ্রাদে শুরু হয়ে সেন্ট পিটার্সবুর্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। জুলিয়ান পঞ্জিকা অনুসারে এই বিপ্লব শেষ হয় ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি শেষ দিকে। এজন্য রাশিয়ার ইতিহাসে এটি ফেব্রুয়ারি বিপ্লব নামে পরিচিত।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ : সুনির্দিষ্ট কোনো কারণে এই বিপ্লব হয়নি। এর পিছনে বহু সমন্বিত কারণ বিদ্যমান ছিল। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো :

১. জার সরকারের রক্ষণশীলতা ও স্বৈরতন্ত্র : ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে পরিবর্তনের স্রোত বইতে শুরু হয়। কিন্তু জার সরকার যুগের গতি অগ্রাহ্য করে স্রোতের বিপরীতে বলতে থাকে । ইউরোপে যখন পুরাতন সমাজ কাঠামো ভেঙে উদারতন্ত্র গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি ঘটেছিল তখন পর্যন্ত রাশিয়ায় জার সরকারের স্বৈরতন্ত্র অব্যাহত থাকে।

সর্বশেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাস ও তার পিতার ন্যায় দমননীতিতে বিশ্বাস করতেন। গুপ্তচর ও পুলিশ দ্বারা তিনি জনমনের স্বাধীনতা খর্ব করতেন। যার ফলে জনগণ বিপ্লবী হয়ে ওঠে।
২. ১৯০৫ সালে বিপ্লবের প্রভাব : ১৯০৫ সালের বিপ্লবে স্বৈরাচারী জার সরকারের গুলিবর্ষণে ১১০ জনের মতো শ্রমিক নিহত হয়। এর ফলে শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলনের ডাক দেয়। জার সরকার এই বিপ্লব দমনে সকল হলেও এই বিপ্লব থেকে শিক্ষা - নিয়ে ১৯১৭ সালের আন্দোলন গতি সঞ্চারিত হয় ।

৩. কৃষক শ্রেণির অসন্তোষ : ১৯১৭ সালের বিপ্লবের অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো রাশিয়ার কৃষক শ্রেণির আন্দোলন। ১৮৬১ সালে রাশিয়ার ভূমিদাস উচ্ছেদ ও যাত্রী স্টোলিপিনের ভূমিসংস্কার আইন পাস করলে রাশিয়ায় কুলাক বা জোতদার শ্রেণির উদ্ভব হয় জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে কৃষক শ্রেণির মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে ।

৪. বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব : এই বিপ্লবের অন্যতম কারণ হলো বলশেভিক পার্টির ভূমিকা। বলশেভিকদের সুদক্ষ নেতৃত্বে এই বিপ্লব সংগঠিত হয়। বলশেভিকরা শ্রমিক কৃষকদের তাদের দলে আনতে সফল হয় এবং লেলিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি। যার ফলে রাশিয়ায় সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহী হয়ে উঠে । যা ১৯১৭ সালের বিপ্লব সংগঠিত করতে আন্দোলন অংশ নেয় ।

৫. সাহিত্যিকদের ভূমিকা : রাশিয়ার সাহিত্যিকদের স্বৈরাচারবিরোধী ভূমিকা বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। টলস্টয় দস্তোয়ভস্কির মতো লেখকরা জার দ্বিতীয় নিকোলাসের নির্যাতন ও দমননীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে নিয়েছিলেন এবং জনগণ তাদের লেখনীর অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনে আগ্রহী হয় ।

৬. শ্রমিক শ্রেণির অসন্তোষ : কৃষকদের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণিও ছিল অসন্তুষ্ট। বিপ্লবের প্রাক্কালে তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়ন করার কোনো অধিকার তাদের ছিল না। এছাড়াও শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নাজুক। মজুরিও ছিল অতি অল্প।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রকৃতি : ১৯১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জার সরকার এর সাথে কৃষক শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবকে “ফেব্রুয়ারি বিপ্লব” বলা হয়। বলশেভিকদের আহ্বানে কৃষক শ্রমিক শ্রেণির রাজধানী পেট্রোগ্রাদে বিপ্লব শুরু করে। সর্বপ্রথম বিপ্লব শুরু হয় পেট্রোগ্রাদের পুলিতভ নামক বলে কারখানার শ্রমিকদের মাধ্যমে। আর অন্যান্য শ্রমিকরাও দলে দলে তাদের মিছিল নিয়ে জড়ো হয়ে এদের মিছিলে যোগ দের। শ্রমিকরা মিছিল দিলে পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড দিলে পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে খণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে আন্দোলনকারী শ্রমিক শ্লোগান তুলে যে-যুদ্ধ নিপাত যাক ও জার নিপাত থাক।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল : ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো :

১. রাশিয়ার রোমানড শাসনের অবসান : এই বিপ্লবের ফলেই রাশিয়ায় রোমানভ শাসনের অবসান হয়। তাদের দীর্ঘ ৩০০ বছরের শাসন ও শোষণে রাশিয়ার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তাদের শাসনের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ।
২. জারতন্ত্রের অবসান : রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমেই জারতন্ত্রের অবসান হয়। সর্বশেষ দ্বিতীয় নিকোলাসই ছিল রাশিয়ার শেষ জার সরকার। এই সরকারের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ।
৩. প্রলেতারিয়েতের বিজয় : এই বিপ্লবের প্রলেতারিয়েডের বিজয় লাভ হয়। শ্রমিক শ্রেণি অসন্তুষ্টির ফলে সকল কলকারখানার বন্ধ হলে সকল শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সফল করে। এছাড়াও রাস্তাঘাট করে দিলেও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে তারা এই বিপ্লবে সফল হয়।
৪. প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রলেতারিয়েত একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
৫. আন্তর্জাতিক প্রলেতারিয়েতের উৎসাহ বৃদ্ধি : ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির বিজয়ে আন্ত জাতিক প্রলেতারিয়েত শ্রেণিও প্রভাবিত হয়। যার ফলে রাশিয়ার মতো অন্যান্য দেশেও প্রলেতারিয়েত বিপ্লব করার চেষ্টা করে।
৬. রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্ভব : এই বিপ্লবে যখন প্রলেতারিয়েত শ্রেণি জয়লাভের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্ভব হয়। সকল ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জার সরকারের পতন ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সর্বোপরি বলা যায়, রাশিয়ায় শ্রমিক কৃষকদের অধিকার আদায় ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই বিপ্লবের ভূমিকা অপরিসীম ।

ভূমিকা : একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পরস্পরবিরোধী দুইটি দেশের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া। দুইটি অংশ ছিল ১৯৩৯ সালে ঘটে যাওয়া এই চুক্তিতে। একটি ছিল প্রকাশিত অপরটি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে গোপন ছিল। এর তাৎপর্য বুঝা যাবে এই চুক্তির দুইটি অংশকে বিশ্লেষণ করলে। একই সাথে আলোচিত ও সমালোচিত এই চুক্তি।

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির ধারাসমূহ/শর্তসমূহ : রুশ- জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি অন্যতম ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির মধ্যে। এই চুক্তিটি অপ্রত্যাশিত ছিল বলে এই চুক্তি ঘটনার মোর ঘুরিয়ে দেয়। একটি অস্থায়ী বা নির্দিষ্ট মেয়াদি চুক্তি ছিল এটি। এই চুক্তি দুই দেশ তার স্বার্থ রক্ষার খাতিরে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী পরস্পর আদর্শ বিরোধী ছিল । হিটলার তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর বাধা কাটানোর জন্য এই চুক্তিটি ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সম্পাদিত করে। ২টি অংশ রয়েছে আলোচিত এই চুক্তির। একটি হলো সবার কাছে উন্মুক্ত বা প্রকাশিত। আর অপরটি দুই দেশের মধ্যে গোপন রাখা হয়। চুক্তির ২টি অংশের শর্ত বা ধারাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

প্রকাশ্য অংশ : মূলত ৪টি ধারা বা শর্ত রয়েছে প্রকাশিত অংশের এবং এটি দুই দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত।
প্রথম শর্ত, চুক্তিবদ্ধ দুই দেশ পরস্পরের উপর কোন অনাক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।
দ্বিতীয় শর্ত, চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের মধ্যে কোন দেশ যদি তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে চুক্তিবদ্ধ অপর দেশ সেই তৃতীয় পক্ষ দেশকে সমর্থন দিবে না ।
তৃতীয় শর্ত, চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে বিবাদ দেখা দিলে তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা হবে ।
চতুর্থ শর্ত, এই চুক্তির শর্তাবলি বা এই চুক্তিটি ১০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে বা বলবৎ থাকবে।
অপ্রকাশিত/গোপন অংশ : দুই দেশের মধ্যে গোপন কিছু শর্ত বা ধারা ছিল এই চুক্তিতে। যা পূর্ব ইউরোপের বিস্তীর্ণ ভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানির প্রভাব বা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ছিল। মূলত দুইটি গোপন শর্তাবলি বা ধারা ছিল এই চুক্তির । যেমন-
প্রথম শর্ত, বাল্টিক অঞ্চলের প্রাধান্য দিয়ে চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের কোনো সমস্যা হয় তবে লিথুনিয়ার উত্তর সীমান্ত হবে রাশিয়া ও জার্মানির প্রভাব বলয়ের সীমারেখা। অর্থাৎ বাল্টিক অঞ্চলের ফিনল্যান্ড, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, বাইলো রাশিয়া এই দেশগুলো রাশিয়ার অধীনে থাকবে আর জার্মানির কাছে লিথুনিয়া দেখা হবে।
দ্বিতীয় শর্ত, পোল্যান্ড দখলের পর তাকে নিয়ে যাতে কোনো সমস্যা না হয় তাই পোল্যান্ডের উপর জার্মানি ও রাশিয়ার প্রভাব বলয় নির্ধারিত হয় নাবিউ, ভিসটুলা ও সান নদীর তীর বরাবর । সুতরাং এর মাধ্যমে জার্মানির কাছে পশ্চিম পোল্যান্ড ও বেসারাবিয়া থাকবে এবং পূর্ব পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন এর দখলে থাকবে।

দুই পরস্পরবিরোধী আদর্শের দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে যা এই চুক্তির প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ধারা বিশ্লেষণ করলে জানা যায়। কিন্তু রাশিয়াকে সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় রেখে নিজের স্বার্থ উদ্ধার এবং পরবর্তীতে আকস্মিকভাবে রাশিয়াকে আক্রমণ করার জন্য হিটলার এই চুক্তি করে। অপরদিকে, আপাতত যুদ্ধকে বিলম্বিত করা এবং এই সময়ের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়াকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার জন্য রাশিয়াও এই চুক্তি করেছিল।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির দুইটি অংশের ধারা বা শর্তগুলো অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ছিল রাশিয়া যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে যায় প্রকাশ্য অংশের ধারার মাধ্যমে এবং জার্মানি গোপন অংশে রাশিয়াকে তার হৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দেয় এর মূল্যস্বরূপ এবং রাশিয়ার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয় পূর্ব পোল্যান্ডে ।

ভূমিকা : বলশেভিক পার্টি অন্যতম ভূমিকা পালন করে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে। এ বিপ্লব সংঘটনের সহায়ক ভূমিকা রাখে তাদের সুদক্ষ নেতৃত্ব। কৃষক ও শ্রমিকদেরকে এ দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয় বলশেভিক দল। তারা প্রতিশ্রুতি দেয় ন্যায্যমূল্যে খাদ্য প্রদান ও শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজ করার। আরও প্রতিশ্রুতি দেয় শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করার। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলশেভিক পার্টি। আন্দোলনে অগ্রসর হয় এবং কৃষক শ্রমিকদের পাশাপাশি সারা রাশিয়ার অরুশ জাতিগুলোর মধ্যেও সচেষ্ট কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে । তোলে লেনিনের যোগ্য নেতৃত্বে বলশেভিকরা। রাশিয়ার বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ ছিল _জারের রুশীকরণ নীতি। বলশেভিক পার্টি এসব কারণেই শ্রমিক কৃষকদের একত্র করে এবং অরুশ জাতিগুলোকে সাথে নিয়েই সংগ্রাম আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। ফলশ্রুতিতে বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯১৭ সালে এবং জারের পতন ঘটে।

বলশেভিক পার্টি : রাশিয়ায় কিভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে হবে এ নিয়ে লেনিন ও জুলিয়াস মারলভের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় ১৯০৩ সালে সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টির লন্ডন কংগ্রেসে । ধীরে ধীরে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে চেয়েছিল ম্যারতভ এবং তাও অপেক্ষাকৃত কম কঠোর নেতৃত্বারোপের মাধ্যমে । অপরদিকে, কঠোর নেতৃত্বারোপের উপর গুরুত্বারোপ করে এবং শ্রমিক কৃষক ও নিপীড়িত জনতাকে সংঘটিত করে রাশিয়ায় জারতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য মতামত প্রদান করেন লেনিন। যার ফলে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় লেনিন ও মারলভের বিপক্ষে চলে যায় পার্টির নেতৃবৃন্দ। পার্টির ভিতর ভোট নির্বাচন হয় এ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। মারলভপন্থিদের থেকে লেনিনপন্থিরা অপেক্ষাকৃত বেশি ভোটে নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়। ফলশ্রুতিতে নিজেদেরকে বলশেভিক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে দাবি করে লেনিনপন্থিরা। অপরপক্ষে, মেনশেভিক বা সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত হয় মারলভের অনুসারীরা।

লেনিন তাঁর বিচক্ষণতার এক নজিরবিহীন নিদর্শন দেখিয়েছেন অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে। “জনগণের জন্য অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত হতে হবে” একথা লেনিন ১০ অক্টোবর বলশেভিক পার্টির এক গোপন বৈঠকে বলেন। কারণ সময় এসে গেছে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদ করার। কেন্দ্রীয় কমটির এ বৈঠকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজধানী পেত্রোগ্রাদকে অভ্যুত্থানের প্রধান কেন্দ্র বা ঘাঁটি নির্বাচন করা হয়। অভ্যুত্থানের বিভিন্ন কার্যাবলি পরিচালনার জন্য “বৈপ্লবিক সামরিক কমিটি” নামে একটি কমিটি গঠন করা হয় পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতে। প্রধানত পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়ন । বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি, স্থল ও নৌবাহিনীর প্রতিনিধি প্রভৃতি সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় এ কমিটি। ১৬ অক্টোবর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় আলোচনা করা | হয় অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। কিন্তু অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ছিলেন জিনোভিয়েভ ও কামোনেভ। ১৮ তারিখে বলশেভিকদের আসন্ন সামরিক অভ্যুত্থানের খবর পত্রিকায় ফাস করে দেয় তারা। পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোতে অস্থায়ী সরকার সামরিক শক্তি সমাবেশ করে অভ্যুত্থান মোকাবিলা করার জন্য। লেনিন এসব কিছুর পরেও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অটল থাকেন। ১৪ অক্টোবর অবশেষে বিপ্লবের সেই কাঙ্ক্ষিত সময় আসে। স্মোলনি ইনস্টিটিউটকে বিপ্লবীদের সদরঘাঁটি নির্বাচন করা হয়। সেখান থেকেই ২৪ অক্টোবর অভ্যুত্থানের সূচনা হয় লেনিনের নির্দেশ অনুযায়ী। বিপ্লবীরা আগেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে দখল করে নেয় সরকারি ভবনগুলো- রেলস্টেশন, ডাক, তার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রভৃতি।তাছাড়া ঘেরাও করা হয় অস্থায়ী সরকারের সদরদপ্তর শীত প্রাসাদ। সদস্যবৃন্দরা আশ্রয় নিয়েছিল যার মধ্যে। ক্রুজার আরোরা থেকে লেনিনের নির্দেশে কামান দাগার সংকেতের মধ্য দিয়ে শীতপ্রাসাদ আক্রমণ শুরু হয় ২৫ অক্টোবর রাত প্রায় ৯:৪৫ মিনিট এর দিকে। বিপ্লবী সৈন্যদল শীতপ্রাসাদ দখল করে নেয় এবং সেখান থেকে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে রাখা হয় পিটারপল দুর্গে। কেরেনেস্কি ও তাঁর অনেক সমর্থক পলায়ন করে রাজধানী থেকে। মহান অক্টোবরে এভাবেই বলশেভিক পার্টির বিপ্লব জয়যুক্ত হয়। এ বিপ্লবের বিজয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হলেও এতে খুব কম রক্তপাত হয়েছিল। এ বিপ্লবের মাধ্যমেই মূলত রাশিয়ায় পুঁজিবাদ ব্যবস্থার নিঃশেষ সাধন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণেই অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে এ বিপ্লবকে আখ্যায়িত করা হয় ।
স্মোলনিতে সৈনিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের দ্বিতীয় সারা রুশ কংগ্রেসে বসে ২৫ অক্টোবর রাতে। এ কংগ্রেসেই গৃহীত হয় সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে গ্রহণের সিদ্ধান্ত। সে সময় ৬৫০ জন কংগ্রেসে উপস্থিত ছিল। প্রায় ৪০০ জন বলশেভিক ছিল এসব প্রতিনিধিদের মধ্যে। মেনশেভিক ও এস. আর সদস্য ছিল বাকিরা। এস.আর ও মেনশেভিকদের অনেকেই বলশেভিকদের সাথে যোগদান করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাছাড়া সর্বসম্মতিক্রমে লেনিন নতুন সরকারের প্রধান বা সভাপতি নির্বাচিত হন। জাতি সংক্রান্ত দপ্তরের ভার স্ট্যালিনকে দেয়া হয় একমাত্র তার অবদানের জন্য। আর বৈদেশিক দপ্তরের ভার দেয়া হয় ট্রটস্কিকে। কৃষক, আর্থিকসহ সকল জনসাধারণের বিজয় সাধিত হয় মূলত এ বিষয়ের মাধ্যমে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, অস্থায়ী সরকারের করুণ পরিণতি পরিলক্ষিত হয় অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে। রাজধানী ছেড়ে তাদের অনেকেই পলায়ন করে। অত্যন্ত গর্বের সাথে বলশেভিকরা তাদের বিজয় লাভ করে। এ বিপ্লবে তেমন কোন রক্তপাত হয়নি যদিও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এ বিপ্লবের জয় অর্জন করা হয় । মূলত জনসাধারণের জয় ছিল এ বিপ্লবের জয়।

ভূমিকা : ১৯১৭ সালে দীর্ঘদিনের জার শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়। কিন্তু বিপ্লবীদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য এসময় রাশিয়ার অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে
পড়ে যায়। তাই স্ট্যালিন ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে রুশ অর্থনীতি পুনর্গঠিত করার জন্য তার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এর ফলে রাশিয়ার সার্বিক উন্নতি সাধিত হয় ।

→ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলাফল : পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে রাশিয়ায় শিল্পের উন্নতি এবং কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি হয় এবং শিক্ষার উন্নতি হয়। নিম্নে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলাফল আলোচনা করা হলো :
১. শিল্পের উন্নতি : স্ট্যালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে রাশিয়ায় শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। এ সময় কয়লা ও খনিজ তেলের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। লৌহ ও ইস্পাত এর উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। বৈদ্যুতিক শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রায় তিনগুণ ।
২. কৃষির উন্নতি : পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রের মোট জমির ২০% যৌথ কৃষি প্রতিষ্ঠানের অধীনে রাখা হবে। যৌথ কৃষি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ফলে কুলার নামক শক্তিশালী কৃষক গোত্রের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পায় ।
৩. শিক্ষার উন্নতি : স্ট্যালিন প্রবর্তিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে রাশিয়ায় শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। পুঁজিবাদী চেতনার পরিবর্তে ছাত্রদের মাঝে সমাজতান্ত্রিক চেতনা বিস্তারের জন্য সারা দেশে অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও টেকনিক্যাল কলেজ স্থাপন করা হয়েছিল। সকল শিশুর জন্য ৭ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে ১৯১৩ সালের শতকরা ৭৩ জন থেকে ১৯৩৩ সালে নিরক্ষরের সংখ্যা ১৯ জনে নেমে আসে।
৪. কৃষকের অবস্থা উন্নতি : যোসেফ স্ট্যালিনের পঞ্চবর্ষিকী পরিকল্পনার ফলে রাশিয়ার কৃষকদের অবস্থা উন্নত হয় । তারা নবউদ্যমে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করে এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে নেমে পড়ে ।
৫. রাশিয়ার অর্থনৈতিক নবজীবন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রাশিয়ার বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা স্ট্যালিনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে নবজীবন লাভ করে রাশিয় বিশ্ব পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৬. আমদানি হ্রাস ও রপ্তানি বৃদ্ধি : পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে রাশিয়ার শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটলে এবং কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে রাশিয়ার বিদেশ নীতিতে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতি গতিশীল হয় ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পরবর্তী অদূরদর্শী সমাজতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে রাজ্যে যে আর্থিক দুর্দশার সম্মুখীন হয় তা ১৯২৮ সালে স্ট্যালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রবর্তনের ফলে দূর হয়, রুশ অর্থনীতি নতুন জীবন লাভ করে। রাশিয়ার বিশ্বসংগ্রামে নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ভূমিকা : পৃথিবীর প্রতিটি বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের পটভূমিতে একজন মূল ব্যক্তি থাকেন। যার নেতৃত্বের কারণে বিপ্লব সফলতার আলো দেখতে পায়। তেমনিভাবে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে যে নামটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তিনি হলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ যিনি লেনিন উপনামেই সর্বাধিক পরিচিত। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং গভীর দেশপ্রেমের কারণে রাশিয়ার একটি সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সালের বুর্জোয়া বিপ্লবের পর বুর্জোয়া সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। কৃষক- শ্রমিকসহ সকল মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে লেনিন "The ..League of Struggle for the Emancipation of Working Class" প্রতিষ্ঠা করেন। তার হাত ধরে ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

১. জন্ম ও পারিবারিক অবস্থা : তার পুরো নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ উপনাম লেনিন। তিনি ভি আই লেনিন নামেও পরিচিত। ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল রাশিয়ার কাজন প্রদেশের যিমরিক্ক শহরে তার জন্ম। বাবা ইলিচ উলিয়ানভ বিদ্যালয়ের প্রাদেশিক পরিচালক এবং মা একজন সুশিক্ষিতা ছিলেন। তিনি মা একাধারে জার্মান, ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মূলত লেনিনের বড় হওয়ার পিছনে তার মায়ের উৎসাহ ব্যাপকভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

২. শিক্ষাজীবন : প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার হতে সমাপ্ত করার পর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হতে লেনিন উচ্চ মাধমিক পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। অতঃপর তিনি কাজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময় কার্ল মার্কস-এর সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার করা বই পুস্তক লেখনীর মাধ্যমে তিনি মার্কসবাদী আদর্শের আকৃষ্ট হন । বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবর তিনি ছাত্রদের পক্ষে একটি দাবি নিয়ে আন্দোলন করায় কাজান বিশ্ববিদ্যালয় হতে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে জার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অপরাধে তাকে একটি গ্রামে আটক করে রাখা হয়। এই আটক অবস্থায় লেনিন মার্কসবাদের সাহিত্যগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।

৩. মার্কসবাদে প্রবেশ : ছাত্রদের পক্ষ জার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অপরাধে লেনিনকে যখন অবরুদ্ধ করে রাখা হয় তখন এই অবসর সময়ে তিনি মার্কসের সাহিত্যগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ পান। দীর্ঘ অধ্যয়ন ও চিন্তার পর লেনিনের উপলব্ধি হয় যে, মার্কসবাদীদের মধ্যেই রাশিয়ার মুক্তি সম্ভব । তাই তিনি কাজানের একটি মার্কসবাদী চক্রে যোগদান করেন। এই চক্রের পরিচালনার ছিলেন এম ই ফেদেসিয়েদ। পড়াশুনার পর তিনি মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা করাকে জীবনের লক্ষ্যে হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। অপরাধ হতে মুক্তি পাওয়ার পর লেনিন সেন্স পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক পাস করেন।

কর্মজীবনের লেনিন : ছাত্র জীবনের সমাপ্তি হলে লেনিন আইন পেশায় যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি মার্কসবাদী আন্দোলনে সক্রিয় হন। নিম্নে বিস্ত ারিত আলোচনা করা হলো :

১. মার্কসবাদী চক্র গঠন : কর্মজীবনের শুরুতে লেনিন সামারায় মারকিট আদালতে আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস শুরু করেন। এটি ছিল ১৮৯২ সালের মার্চ মাস। যেখানেই লেনিন তার ধ্যান-জ্ঞান মার্কসবাদী চক্র গড়ে তোলেন। এখানে অবস্থানকালীন মার্কসবাদী লেখক প্লেখানড-এর "Our Difference" গ্রন্থটি অধ্যয়ন করেন ।

২. সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক গ্রুপের সদস্য : সামারায় মার্কসবাদের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার পর লেনিন সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে যান। পিটার্সবার্গের গিয়ে তিনি মার্কসবাদের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক গ্রুপের সাথে যুক্ত হন। তিনি এই গ্রুপে একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও তত্ত্ব প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। লেনিন তার অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা দ্বারা উপলব্ধি করেন যে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শ্রমিক শ্রেণিকে এই আন্দোলন যুক্ত করতে হবে।

৩. ঐক্যবদ্ধ মার্কসবাদী পার্টি গঠন : ১৯৮৫ সাল সেপ্টেম্বর মাস। এ সময় লেনিন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে তিনি মার্কসবাদী ও সোশ্যালিস্ট পার্টিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০টি মার্কসবাদী চক্রকে একত্রিত করে একটি লীগ গঠন করেন । যার নাম দেওয়া হয় "The leaugue of struggle for the emancipation of the working class.' এটি ছিল রাশিয়ার মার্কসবাদী দল গঠনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম পদক্ষেপ।

  1. পত্রিকা ও প্রকাশনা : ১৯০০ সালটি ছিল রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর ভ্লাদিমির লেনিন মার্কসবাদ প্রচারের জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর এক্ষেত্রে মার্কসবাদী লেখক প্লেখানড তাকে সহায়তা করেন। লেনিনের প্রকাশিত পত্রিকার নাম দেওয়া হয় ইসক্রা। ইসক্রা শব্দের অর্থ স্ফুলিঙ্গ ।

৫. লেখালেখির মাধ্যমে মার্কসবাদ প্রচার : মার্কসবাদ প্রচারের জন্য লেনিন যে পত্রিকাটি প্রকাশ করেন তা ১৯০০ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়। ইসক্রা নামক এই পত্রিকাটি মার্কসবাদ প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকার মাধ্যমে লেনিনের সমাজতন্ত্রের উপর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্কসবাদের প্রচার শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং বিপ্লবের বাণী প্রচার করা ।

৬. ১৯০৩-এর লন্ডন সম্মেলন : ১৯০৩ সালে লেনিন বিপ্লবী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে লন্ডনে একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে তিনি দুটি বিষয়ে আলোকপাত করে বক্তব্য প্রদান করেন। প্রথমত, এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য নিয়ে। আর তা হলো সফল সমাজতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ দল গঠন করা, দ্বিতীয়ত এ দলের কর্মসূচি ঘোষণা। এর কর্মসূচি হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এ সম্মেলন হতে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ৷

৭. এপ্রিল থিসিস : ১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল দিনটি রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিন লেনিন তার দীর্ঘদিনের চিন্তা গবেষণা হতে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তা প্রকাশ করেন। এটি এপ্রিল থিসিস নামে পরিচিত। এপ্রিল থিসিসে তিনি বলেন, ১. সামরিক সরকারের সাথে সমঝোতা হবে না; ২. যুদ্ধ বন্ধের প্রচারণা চালাতে হবে; ৩. সকল ভূ-সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ করা হবে; ৪. দশের সর্বত্র সোভিয়েতগুলোতে ক্ষমতা দখল করতে হবে; ৫. বলশেভিক কম্যুনিস্ট নামে পরিচিত হবে ও ৬. উৎপাদন ও বণ্টনের উপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৮. জুলাই বিক্ষোভ : ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে দক্ষিণ গ্যালিসিয়া উদ্ধারের জন্য হামরা করে। এ হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হলে রাশিয়া ইউক্রেনের একটি অংশ জার্মানির কাছে হারায় এবং এতে প্রায় ৬০,০০০ সাধারণ সৈনিক হতাহত হয়। এ অভিধানের জনগণ বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। প্রায় ৫ লক্ষ কৃষক-শ্রমিক ও জনতা একত্রিত হয়ে পেট্রোগ্রাদ শহরে বিক্ষোভে প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভে কিছু সৈনিক যোগদান করে এবং তারা একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। লেনিন এই সিদ্ধান্তে সমর্থন দেননি।

৯. আত্মগোপন : জুলাই মাসের ঘটনার পর বলশেভিক পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এ পার্টির বহু নেতাকর্মী হতাহত এবং গ্রেফতার হয়। দলের সভাপতি লেনিনকে সরকার জার্মানির হিসেবে প্রচার করতে হবে এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেফতার এড়াতে তিনি ফিনল্যান্ডে আত্মগোপন করেন এবং সেখান থেকে গোপনে পার্টিকে নির্দেশনা দিতে থাকেন।

১০. সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত : ১৯১৭ সালের আগস্ট মাসে লেনিনের অনুমতিক্রমে ও তার নির্দেশে দলের ৬ষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এটি দল নিষিদ্ধ হওয়ার পর প্রথম কংগ্রেস। উত্ত কংগ্রেসে দলের দু'জন সদস্য ছাড়া বাকি সবাই সশস্ত্র বিপ্লব করার পক্ষে ব্যয় দেন। লেনিনের নিজেরও এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বলশেভিক দলের দু'জন সদস্য এই সিদ্ধান্তে দ্বিমত থাকায় তা ফাঁস করে দেয়। এর ফলে বুর্জোয়া সরকার ভীত হয়ে পড়ে ৷

১১. অক্টোবর বিপ্লব এবং দেশ গঠনে লেনিন : ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসে যায়। ১০ অক্টোবর তারিখে পার্টির বৈঠক বসে। এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে গ্রহণ করা। পার্টি বৈঠকে উপস্থিত সদস্যদের সকলে ২৫ অক্টোবর তারিখে, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পেট্রোগ্রাদ দখল করা হবে। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৫ তারিখ বলশেভিক পার্টির নেতাকর্মীর শ্রমিক মুক্তিকামী জনগণের সাথে নিয়ে পেট্রোগ্রাদ শহরে প্রবেশ করে। এতে বুর্জোয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কি পালিয়ে যায়। বলশেভিক পার্টি বিনা বাধা ও বিনা রক্তপাতে রাজধানী দখল করে বিপ্লবের পর লেনিন দুটি ডিক্রি জারির মাধ্যমে দেশের সকল সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করেন। একটি সমাজতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এভাবে মহানায়ক লেনিন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৮৭০ সালে জন্মগ্রহণ করা রাশিয়ার এই মহানায়ক লেনিন মাত্র অল্প সময় রাশিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপদান করতে সক্ষম হন। বিপ্লবের পর একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডহীন রাষ্ট্রকে অত্যন্ত সুকৌশলে তিনি তিলে তিলে গড়ে তোলেন। দেশের ধর্মীয়, সামাজিক সকল প্রকার সংস্কার করেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধ হতে রাশিয়াকে সরিয়ে এনেও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। লেনিন শান্তির জন্য ডিক্রি ও ভূমির জন্য ডিক্রি জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন ।

ভূমিকা : যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সোভিয়েত রাশিয়ায় সংঘটিত হয় তখন এটিকে মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। এজন্য রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ধারা সূচনাতেই বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে তারাও বিদেশি পুঁজিবাদী শক্তি। বৈদেশিক আক্রমণ হস্তক্ষেপকারীরা রাশিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় দেশের ভূ-স্বামী ও পুঁজিপতিদের সহায়তায় । সেই সাথে সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে পুরাতন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে তারা।

গৃহযুদ্ধ : গৃহযুদ্ধ এক ধরনের যুদ্ধ যা নির্দিষ্ট কোন রাষ্ট্র বা দেশের অভ্যন্তরে সাংগঠনিকভাবে দুই বা ততোধিক দল বা গোষ্ঠী সরাসরি যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ অর্থে গৃহযুদ্ধের ফলে দুটি স্বাধীন দেশ সৃষ্ট হয় যা পূর্বে একীভূত দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক পক্ষ কর্তৃক দেশ বা এলাকা নিয়ন্ত্রণ, অঞ্চল বা এলাকার স্বাধীনতা ঘোষণা অথবা সরকারের নীতি নির্ধারণে পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ এ যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য ।

ল্যাটিন ভাষায় “বেলাম সিভিল” শব্দ থেকে সিভিল ওয়ার (Civil war) পদটির উৎপত্তি ঘটেছে। খ্রীষ্টপূর্ব ১ম শতকে রোমান গৃহযুদ্ধে শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ভাষায় সিভিল ওয়ার শব্দটি ইংরেজ গৃহযুদ্ধে প্রথম প্রচলন হয় ১৬৫১ সালে ।
কখনো কখনো দলভুক্ত জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নতুন দেশ তৈরিতে আগ্রহী নন। কিন্তু তারা তাদের অধিকারবোধ ও দাবী দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশ পরিচালনা পদ্ধতিতে সম্পৃক্ত হতে চান। এ ধরনের গৃহযুদ্ধ মূলত দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ।

গৃহযুদ্ধ উচ্চ পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয় যাতে প্রায়ই অনুমোদনকৃত প্রশিক্ষিত, সংগঠিত বৃহৎ আকৃতির নিয়মিত সামরিক বাহিনী জড়িয়ে পড়ে।
গৃহযুদ্ধের কারণ : যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সোভিয়েত রাশিয়ায় সংঘটিত হয় তখন এটিকে মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। এজন্য রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ধারা সূচনাতেই বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে তারাও বিদেশি পুঁজিবাদী শক্তি। বৈদেশিক আক্রমণ হস্তক্ষেপকারীরা রাশিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় দেশের ভূ-স্বামী ও পুঁজিপতিদের সহায়তায়। সেই সাথে সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে পুরাতন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে তারা। বিভিন্ন কারণে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হলেও মূলত কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। যথা-

১. রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গ্রহণ কিংবা দেশ পরিচালনা পদ্ধতি বিষয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতানৈক্য ঘটলে গৃহযুদ্ধ ঘটে। দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো একটি দল যদি নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয় কিংবা দু দলের মধ্যে কোনোরূপ চুক্তি সম্পাদন না হয় তাহলেও তা গৃহযুদ্ধের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. এক দলভুক্ত জনগোষ্ঠী ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদিতে ভিন্নতাজনিত কারণে যদি দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে ইচ্ছা প্রকাশ না করে তাহলেও গৃহযুদ্ধ হতে পারে। এ ধরনের বুদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদ নামে পরিচিত। তখন তারা দেশ বিভাজন করে নতুন একটি স্বাধীন দেশের জন্যে গৃহযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়। খুব কমসংখ্যক জাতীয় নেতৃবৃন্দ এতে অংশ নিতে পারেন। অধিকাংশ জাতীয় নেতা-ই দেশ বিভাজনে অংশ নিতে চান না যার ফলশ্রুতিতে অনিবার্যভাবে তা গৃহযুদ্ধের আকারে মোড় নেয় ।

৩. রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলে বৈদেশিক পুঁজিপতি রাষ্ট্রগুলো একে মেনে নিতে পারেনি। তারা এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের ভয় ছিল এমন বিপ্লব তাদের দেশে হলেও তারা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য তারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে তারা সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাশিয়াকে দখল করার চিন্তা করে।

৪. ফরাসি, মার্কিন ও জার্মানি সরকার সোভিয়েত সরকারে স্বীকার না করে সব ধরনের চুক্তি বাতিল করে। এছাড়া তারা সোভিয়েতে আক্রমণ করে বিভিন্ন এলাকা দখল করে এবং প্রতিবিপ্লবীদের বিভিন্নভাবে গৃহযুদ্ধে সহায়তা করে ।

৫, দেশের পুঁজিপতি ও ভূ-স্বামীরা সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুঁজিপতিরা সমাজতন্ত্রের ফলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা হারায়। তাই তারা সরকারকে সহায়তা করতে অস্বীকার করে। পুঁজিপতি ছাড়া ভূ- স্বামীরাও সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিল। সমাজতন্ত্রের কারণে ভূস্বামীদের ভূমি রাষ্ট্রের অধীনে চলে গেলে তারা নিঃস্ব হয়ে যায় । তাই তারা সমাজতন্ত্র ও সরকারের বিরোধিতা করে।

৬. কখনো কখনো দলভুক্ত জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নতুন দেশ তৈরিতে আগ্রহী নন। কিন্তু তারা তাদের অধিকারবোধ ও দাবি দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশ পরিচালনা পদ্ধতিতে সম্পৃক্ত হতে চান। এ ধরনের গৃহযুদ্ধ মূলত দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সোভিয়েত রাশিয়ায় সংঘটিত হয় তখন এটিকে মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। এজন্য রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ধারা সূচনাতেই বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে তারাও বিদেশি পুঁজিবাদী শক্তি। বৈদেশিক আক্রমণ হস্তক্ষেপকারীরা রাশিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় দেশের ভূ-স্বামী ও পুঁজিপতিদের সহায়তায় । সেই সাথে সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে পুরাতন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে তারা।

৭. গৃহযুদ্ধ উচ্চ পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয় যাতে প্রায়ই অনুমোদনকৃত প্রশিক্ষিত, সংগঠিত বৃহৎ আকৃতির নিয়মিত সামরিক বাহিনী জড়িয়ে পড়ে।

এছাড়া সমাজতন্ত্রের কারণে আরো অনেক শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন- প্রাক্তন সরকারি অফিসার, আমলাবর্গ, যাজক শ্রেণি, ব্যাংকার ও জারের প্রাক্তন সৈন্যবাহিনী। এরা সবাই পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের সাথে চক্রান্তে শামিল হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গৃহযুদ্ধ একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। কিন্তু তারপরেও একটি দেশে গৃহযুদ্ধ অনেক কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তিগুলোর মধ্যে রাশিয়া একটি। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে রাশিয়াতে সম্রাট বা জার শাসনামল ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাশিয়াতে বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন শুরু হয়। বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে জার বিরোধী প্রচারণা শুরু করেন। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম একজন ব্যক্তি ছিলেন কার্ল মার্কস। তিনি রাশিয়ার জার প্রথাকে বিলুপ্ত করে একটি নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। এ লক্ষ্যে ১৮৭৬ সালে তিনি একটি বই রচনা করেন যার নাম দেয়া হয় ‘Das Kapital'। পরবর্তীতে এই বইটি সমাজতন্ত্রের বাইবেল হিসেবে খ্যাতিলাভ করে ।

মার্কসবাদ : রাশিয়ার নবরাজনীতির রূপ কাঠামো হিসেবে কার্ল মার্কস যে Theory বা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন তাকে মার্কসবাদ বলেছেন। কার্ল মার্কস রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথাকে বিলুপ্ত করে এবং জারদের পতন ঘটিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। মেই রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির সম্পদ থাকবে না। সকল সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র । জনগণ তার প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্র থেকে গ্রহণ করবে। আর সর্বদা রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করবে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং এর নিয়ম-কানুন সমাজেই তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন যার নাম 'Das Kapital'। এই বইটি সমাজতন্ত্রের বাইবেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমাজতন্ত্র | প্রতিষ্ঠায় মার্কস যে Theory বা কার্যপ্রণালি বর্ণনা করেছেন সেসব কার্যপ্রণালি মার্কসবাদ হিসেবে পরিচিত।
রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রসার : কার্ল মার্কস ছিলেন মূলত জার্মানির নাগরিক। তিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করার চেষ্টা করেন। যেটি মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র হিসেবে পরিচিত। রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রসার র সম্পর্কে বিবরণ পেশ করা হলো :
১. Das Kapital : কার্ল মার্কস তাঁর Theory-কে মানুষের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে একটি বই রচনা করেন। যেটি সমাজতন্ত্রবাদীরা তাদের সমাজতন্ত্রের বাইবেল বা সংবিধান হিসেবে মনে করেন। তিনি 'Das Kapital' নামে একটি বই রচনা করেন। রুশ ভাষায় বইটি অনুবাদ করে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রবাদীরা নিজ দেশে সমাজতন্ত্রের প্রচারাভিযান শুরু করেন।
২. কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর উত্থান : ১৮৭০-এর দশকে তা ক রাশিয়াতে বুদ্ধিজীবীদের লেখনী আন্দোলন প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। চ্ছ তাদের লেখনীতে কিছু সংখ্যক লোক প্রভাবিত হয়ে কমিউনিস্ট ত্ব | পার্টি তৈরি করে। আদর্শগত পার্থক্যের কারণে কমিউনিস্টরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত যায় ।

৩. রুশ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা:রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র প্রসারে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিলেন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। সূচনা তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের ভালো দিকগুলো করে। জনগণের মাঝে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এর ফলে জনগণ | লাভ ক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে সামিল হয়।

৪. মার্কসবাদী চক্র গঠন : ১৮৬১ সালে রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রশ্ন প্রথা উচ্ছেদের পর মানুষ শহরে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় শ্রমিক অবদ ' হিসেবে কাজে যোগদান শিল্পকারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগদান করে। মার্কসবাদী সমর্থগণ শ্রমিকদেরকে মার্কসৰাদে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানায় এতে কিছু শ্রমিক যোগদান করলে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, কাজান, কিয়েভ প্রভৃতি শহরে মার্কসবাদী চক্র গড়ে ওঠে ।

৫. রুশ রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিকরণ : রাশিয়াতে ছিলেন সমাজতন্ত্র প্রসারের পূর্বেই অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গড়ে সাম্রাে ওঠে। এই দলগুলোর মধ্যে রুশ স্যোশাল ডেমোক্রেটিক রাজন দলগুলোকে একত্রিত করে সংঘবদ্ধ করা হয়। এদের মাধ্যমে প্রয়াস রাশিয়াতে মার্কসবাদের প্রচার কার্য চালানো হয়। এর ফলে মার্কসবাদের দ্রুত প্রসার ঘটে।

৬. নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা : রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র | গ্রহণ প্রসারের জন্য ১৮৮৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে 'Marsist Social | প্রতি Democratic Party' নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বুলগেরীয় সাম্যবাদী নেতা ব্লাগোইয়েভ । এই দলের মূল কাজ ছিল মার্কসবাদ প্রচার করা।

৭. Labour Party গঠন : রাশিয়ার শ্রমিকদেরকে মার্কসবাদ প্রসারে কাজে লাগাতে নতুন আরো একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই রাজনৈতিক দলের নাম দেয়া হয় 'Russian Social Democratic Labour Party' এই দলের মূল কাজ ছিল শ্রমিকদেরকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা এবং অন্য দলের নেতাদের তদারকি করা।

৮. জনগণের কল্যাণে কাজকরণ : মার্কস কর্মীরা জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন সেবামূলক কার্য পরিচালনা করেন। এর ফলে জনগণ মার্কসবাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয় এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র প্রসার লাভ করে।

৯. জারদের বিরুদ্ধে প্রচারণা : মার্কসবাদীরা গোপনীয়ভাবে জারদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় এবং জনগণকে জার বিরোধী আন্দোলনে প্ররোচনার যোগান দেয়। জার বিরোধী প্রচারণার ফলে জনগণ জারদের প্রতি বিরাগভাজন হয় এবং মার্কসবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফলে রাশিয়াতে মার্কসবাদের প্রসার ঘটে।

১০. মার্কসবাদের প্রচার : মার্কসবাদীরা জনগণের নিকট মার্কসবাদের সুবিধাগুলো প্রচার করতে থাকে। এর ফলে নির্যাতিত মানুষগুলো মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং নিজেদের মাঝে মার্কসবাদের প্রচারণা চালাতে থাকে। এর ফলে রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রসার লাভ করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাশিয়াতে মার্কসবাদের সূচনা সে দেশের রাজনীতিতে নব রাজনীতির পথ প্রসারিত করে। মার্কসবাদের প্রসারের ফলে রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মার্কসবাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ভূমিকা : রুশ বিপ্লবের প্রথম সূচনা হয়েছিল মূলত ১৯০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসে একে ব্লাডি সানডে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জার দ্বিতীয় নিকোলাস শাসনের বিরুদ্ধে সেদিন তরুণ ফাদার গাপনের নেতৃত্ব এক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জারের পোটোয়া বাহিনী। প্রকাশ্যে বিনা বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে জনগণ বিক্ষোভ ডাকলে হরতাল অবরোধে পুরো রাশিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি শ্রেণি ও শ্রমিকরা পার্লামেন্ট শাসনের দাবি জানান। কৃষক শ্রেণি জমিদার থেকে তাদের জমি দখলে নিয়েছিল এবং সৈন্যরা জনগণের সাথে মিলে বিদ্রোহের ঘোষণা দেয়। এর ফলে পরবর্তীতে অন্যান্য বিপ্লব উৎসাহিত হয়েছিল।
১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলাফল : সাধারণত ১৯০৫ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হলেও রাশিয়ার জারতন্ত্রের মূলে আঘাত হানে। স্বৈরাচারী কার্যক্রমের মাধ্যমে যে আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যায় না। তা জ দ্বিতীয় নিকোলাস এই বিপ্লবের থেকে বুঝতে সক্ষম হয় ।
১. ১৯১৭ সালের পটভূমি সৃষ্টি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমি সৃষ্টি হয় ১৯০৫ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের মাধ্যমে। এই বিপ্লবের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার নতুনভাবে পদক্ষেপ নেয় ।
২. সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন : রাশিয়ার ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে সমাজ কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়। যার পলে পরবর্তীতে সকল শ্রেণির জনগণ একতাবদ্ধ হয়ে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আওয়াজ তোলে ।
৩. অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন : ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে অভ্যন্ত রীণ পরিবর্তন হয়। শ্রমিক, কৃষক, সকল শ্রেণির জনসাধারণ একসাথে জারতন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। যার ফলে রাশিয়ার প্রচলিত আমলাতন্ত্র চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়।
৪. আন্তর্জাতিক প্রভাব : ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার উপর আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তার করে। এতে রাশিয়ার অনুপ্রেরণার অন্যান্য দেশের জনগণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু করে। যেমন- ইতালি, হাঙ্গেরি, জার্মানির, শ্রমিকরা রাশিয়ার অনুপ্রেরণার সংগ্রামকে আরো গতিশীল রূপ দেয়। যার ফলে বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯০৫ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের পিছনে নানাবিধ কারণ প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে। তবে এই বিপ্লবের মূল কারণটি ১৯০৪-০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধের মধ্যে নিহিত ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকের ভূমিকাও ছিল পর্যাপ্ত। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার সামাজিক পরিবর্তনসহ সারা বিশ্বে স্বৈরাচারী আন্দোলনের সূচনা সৃষ্টি হয় ।

ভূমিকা : জার প্রথম নিকোলাস সাম্রাজ্যবাদী ও ঘোর রক্ষণশীল ছিলেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও তাঁর এই ছাপ পরিলক্ষিত হয়। বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে তিনি ইউরোপের রক্ষণশীলতার প্রতি সমর্থন, প্যারিসের সন্ধি, গ্রিসের বিদ্রোহসহ নানাবিধ কার্যাবলি সম্পাদন করেন। জার প্রথম নিকোলাসের পরিচয় : প্রথম নিকোলাস ছিলেন রাশিয়ার জারিনা (Czarina) দ্বিতীয় ক্যাথরিনের পৌত্র, জার প্রথম পলের পুত্র এবং জার প্রথম আলেকজান্ডারের ভ্রাতা। ১৭৯৬ সালের ৬ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ভ্রাতা প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ১৮২৫ সালে জার প্রথম নিকোলাস রাশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল ও প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল। তার সময়ে উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার বিরুদ্ধে অবিরাম অভিযান চলে। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সিংহাসনে আরোহণের সময় রাশিয়ার সর্বত্র বিক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিলে তিনি তা কঠোর হস্তে দমন করেন। তিনি একদিকে যেমন বাস্তবপন্থি, অন্যদিকে প্রাচীনপন্থি ও সংস্কার বিরোধী ছিলেন। তবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় প্রথম নিকোলাস মেটারনিকের প্রভাব হতে নিজেকে মুক্ত রেখে ইউরোপের রাজনীতিতে রাশিয়ার সম্মান ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি করেন।

→ জার প্রথম নিকোলাসের বৈদেশিক নীতি : জার প্রথম নিকোলাসের পররাষ্ট্রনীতি/বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ইউরোপের রক্ষণশীলতার প্রতি সমর্থন : গৌরনিকের মতো জার প্রথম নিকোলাস ও ইউরোপের রক্ষণশীলতাকে সমর্থন করেন। রক্ষণশীল মনোবৃত্তির ফলেই জার প্রথম নিকোলাস সাম্রাজ্যের সকল প্রভাব বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন।
২. গ্রিস বিদ্রোহ মোকাবিলা : তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিসে বিদ্রোহ দেখা দিলে নিকোলাস তা দমনের জন্য উদ্যত হন। নাভারিনের যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে জার প্রথম নিকোলাস তুরস্কের উপর আদ্রিয়ানোপলের সন্ধি চাপিয়ে দেন। ফলে এর মাধ্যমে গ্রিসের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় এবং গ্রিস পরোক্ষভাবে রাশিয়ার আশ্রিত রাজ্য পরিণত হয়।
৩. পোল্যান্ডের বিদ্রোহ দমন : ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবের ফলে পোল্যান্ডে জাতীয় বিদ্রোহ দেখা দেয়। নিকোলাস তা কঠোরহস্তে মোকাবিলা করেন। এমনকি তিনি পোলিশদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নাকচ করে দেন এবং পোল্যান্ডে রুশ নীতি বলবৎ রাখেন ।
৪. প্যারিসের সন্ধি : প্যারিস সন্ধির মাধ্যমে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে। ভবিষ্যতে তুরস্ক যাতে রুশদের দ্বারা আক্রান্ত না হয় : সেজন্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বিজয়ী শক্তিবর্গ বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। মোলদাতিয়া ও ওয়ালবিয়া অঞ্চল থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার করা হয়। রাশিয়া বেসারাবিয়া প্রদেশ হরসূকে ফেরত দেয়।
৫. উনকিয়ার স্কেলেসির সন্ধি : জার প্রথম নিকোলাস উনকিয়ার স্কেলেসির সন্ধির মাধ্যমে দার্দানেলিস প্রণালিতে অবাধে রুশ জাহাজ চলাচলের অধিকার লাভ করেন। মূলত তুর্কি সরকার বিদ্রোহী সামন্ত মুহাম্মদ আলীকে দমন করার জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা চেয়েছিলেন, এই সাহায্যের প্রতিদান স্বরূপ রাশিয়া এই সুবিধা লাভ করে ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জার প্রথম নিকোলাসের শাসনামলে রাশিয়ার বৈদেশিক সম্পর্ক তেমন শক্তিশালী ছিল না। আর্মোনিয়ানদের নিকট পরাজিত হওয়ার পর অবশেষে প্যারিসের সন্ধির মাধ্যমে রাশিয়াকে দুর্বল করে ফেলা হয়। এতে জার নিকোলাস হতোদ্যম হয়ে পড়েন এবং রাশিয়া অথযাত্রাও থমকে দাঁড়ায় ।

ভূমিকা : উনিশ শতকে রাশিয়ার সমাজ কাঠামো মধ্যযুগীয় ও সামন্ত্রতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হতো। এ সময় রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা চালু ছিল। যার ফলে সমাজে বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান ছিল। ভূমিদাস প্রথা চালু থাকায় এ সমাজে অনেক পিছিয়ে ছিল। রাজকীয় সম্পত্তির অধিকারীরা ভালো থাকলেও ভূমি ভূমিদাসদের জীবনমান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। রাশিয়ায় তখন স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। অর্থনীতি ছিল সামন্ত প্রথাভিত্তিক। ভূমিদাসদের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হতো। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে সামন্ত প্রথার পতন হলে রাশিয়ায় পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা শুরু হয়।

উনিশ শতকে রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা : উনিশ শতকে রাশিয়ায় এক ব্যক্তির শাসন অর্থাৎ স্বৈরতন্ত্র শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। জার বা সম্রাট ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি অভিজাত শ্রেণির পরামর্শকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। এক্ষেত্রে জনসাধারণের মতামত প্রদানের কোনো সুযোগ থাকতো না। উনিশ শতকের কিছু সম্রাটের শাসনামলে রাশিয়া বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়। সেসব সম্রাটের মধ্যে ক্যাথারিন, পিটার দ্যা গ্রেট, দ্বিতীয় আলেকজান্ডার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।
জার তৃতীয় আলেকজান্ডার ও দ্বিতীয় নিকোলাস ছিলেন স্বৈরাচারী নীতির অনুসারী। তারা রাশিয়ায় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও রোধ করেন। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার এক জার, এক গির্জা এবং এক রাশিয়ার আদর্শ ঘোষণা দেন। এ আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি রাশিয়ায় উদারতন্ত্র ও গণতন্ত্র বাতিল করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সর্বত্রই রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করেন। তিনি তার পিতা দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের হত্যাকারীদের কারাদণ্ড দেন।

জার তৃতীয় আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসে Land Captain নামক এক শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করে রাশিয়ায় পুনরায় সামন্ত্রতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। Land Captain কর্মচারীরা জনসাধারণের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার করতো। এদের হাতে তৃতীয় আলেকজান্ডার প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রদান করেন। তৃতীয় আলেকজান্ডার ১৮৬১ সালের ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ অনেক অর্থ আদায় কতো অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো।

→ উনিশ শতকে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থা : নিম্নে উনিশ শতকের রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করা হলো : ১. শিল্পের অগ্রগতি সাধন : উনিশ শতকে রাশিয়ায় শিল্প 5 ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন হয়। জার নিকোলাস, দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ও তৃতীয় আলেকজান্ডারসহ প্রত্যেক সম্রাট শিল্পের T/ অগ্রগতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উনিশ শতকে য় রাশিয়ায় ভারি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। বিশেষ করে লোহা, ন্ন অস্ত্র, রেলপথ এসব শিল্পসমূহ। রাশিয়া কৃষিনির্ভর দেশ থেকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়।

২. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি : অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ । ব্যবস্থার উন্নতি অপরিহার্য। উনিশ শতকে রাশিয়ায় পরিবহণ ও ত যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন হয়। রাস্তাঘাটের র উন্নয়নসহ জলপথেরও ব্যাপক উন্নয়ন করা হয় । যোগাযোগ ব্যবস্থার শ | সুবিধার্থে উনিশ শতকে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয় ।

৩. ভূমিদাস প্রথা বিলোপসাধন : মুক্তি আইনের মাধ্যমে ১৮৬১ সালে ভূমিদাস প্রথা বিলোপ করা হলে রাশিয়া সামত কে সমাজ থেকে পুঁজিবাদী যুগে প্রবেশ করে। ভূমিদাসরা মুক্তিলাভ স্থা করে শহরে এসে কলকারখানায় নিযুক্ত হয়। এ সময় ী। কৃষিক্ষেত্রেও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। দেশের সামগ্রিক উৎপাদন কে বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

৪. বৈদেশিক বাণিজ্য ও উৎপাদিত কৃষিপণ্য : এ সময় কিছু রাশিয়া বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বৈদেশিক বাণিজ্যের সুবিধার্থে রাশিয়া সমুদ্র বন্দর স্থাপন এট করে। ফলে বাণিজ্য আরো সহজতর হয়। রাশিয়া সহজে পশ্চিম ইউরোপের সাথে শস্য ও বিভিন্ন কাঁচামাল রপ্তানি করতে পারে।

৫. শ্রমিকদের দুরবস্থা : এ সময় রাশিয়ার শ্রমিকদের অবস্থা ভূমিদাসদের মতো শোচনীয় শ্রমিকদের ছিল। অভিজাত শ্রেণি দ্বারা তারা নির্যাতিত হতো। তারা নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতো। তারা অমানুষিক পরিশ্রম করলেও সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেতো না ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ না হওয়ায় তখন অভিজাত শ্রেণি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করতো। সে সময় সার্ফ বা ভূমিদাস কিংবা কৃষকদের জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯০৫ সালে বিপ্লব এবং ১৯১৭ সালে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram