nulibrary

ভূমিকা : ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা। আইন পরিষদগুলোতে ভারতীয় সদস্য গ্রহণের যে প্রস্তাব পাস করা হয় তা ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন দ্বারা আরো সম্প্রসারণ করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন হয়। তাছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ধারায় ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনে একটি অন্যতম পদক্ষেপ ছিল বলে মনে করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে কাউন্সিলগুলোর সদস্যদের অধিকার বৃদ্ধি করায় সরকারের নানামুখী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার অধিকার লাভ করে।

→ ১৮৯২ সালের আইনের ধারা বা বৈশিষ্ট্যসমূহ : ভারতীয় কাউন্সিল আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ সম্প্রসারণ : তৎকালীন সময়ে ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। কেন্দ্রীয় পরিষদে সর্বনিম্ন ১০ জন এবং সর্বোচ্চ ১৬ জন সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে ১৬ জন অতিরিক্ত সদস্যর মধ্যে বেসরকারি সদস্য থাকবেন ১০ জন। ১০ জনের মধ্যে ৪ জন প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য দ্বারা, একজন কলকাতা চেম্বার অব কমার্স এবং পাঁচ জন গভর্নর জেনারেল কর্তৃক বিভিন্ন শ্রেণি হতে নিয়োগ হবেন।

২. গভর্নর জেনারেলকে ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ : ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা গভর্নর জেনারেলকে সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। তবে ভারত সচিবের অনুমোদন সাপেক্ষে গভর্নর জেনারেলকে এ ক্ষমতা প্রয়োগের কথা উল্লেখ করা হয় ।

৩. আইন পরিষদ সদস্যদের সমালোচনার সুযোগ : ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা আইন পরিষদের সদস্যদের কিছু শর্তসাপেক্ষে সরকারের অর্থনৈতিক রিপোর্ট সমালোচনা বা সমালোচনা করার সুযোগ সৃষ্টি তাদেরকে সমালোচনা করার সুযোগ দিলেও তারা এ রিপোর্ট সংশোধন করতে পারে না ।

৪. প্রাদেশিক আইন পরিষদের ক্ষমতা : ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের গভর্নর জেনারেলের পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে প্রাদেশিক আইন পরিষদকে নতুন আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা এবং পুরাতন আইন বাতিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়। তবে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকে ।

৫. আইন পরিষদের সদস্যদের জনস্বার্থ বিষয়ক আলোচনা করার অধিকার : ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা আইন পরিষদের সদস্যদের জনস্বার্থ বিষয়ক প্রশ্ন তথা আলোচনা করার অধিকার দেয়া হয়। গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের দ্বারা প্রণীত বিধি অনুযায়ী সদস্যদের প্রশ্ন করার কথা বলা হয়। তবে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট কোনো কারণ ছাড়াই যেকোনো প্রশ্ন বাতিল অথবা জনস্বার্থের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এ অজুহাতে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দানে অসম্মতি জানাতে পারেন ।

৬. মুম্বাই ও মাদ্রাজ আইন পরিষদের সদস্য বৃদ্ধি: আইনের মাধ্যমে মুম্বাই ও মাদ্রাজ আইন পরিষদগুলোর সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ৮ জন আর সর্বোচ্চ ২০ জন করা হয়। প্রদেশে জেলাবোর্ড, পৌরসভা, পরিষদের আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং চেম্বার অব কমার্সের দ্বারা নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। মাদ্রাজ আইন পরিষদের ২০ জন অতিরিক্ত সদস্যদের মধ্যে ৪ জন বেসরকারি ৯ জন সরকারি এবং অপর ৩ জন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাজ কর্পোরেশন ও চেম্বার অব কমার্স হতে নির্বাচন করা হয় ।

৭. বাজেট সম্পর্কে সমালোচনা : কাউন্সিলের সদস্য বা কাউন্সিলের সভায় সরকারের আয় ব্যয় বা বাজেট সম্পর্কে সমালোচনা করার অধিকার লাভ করে। যার মাধ্যমে কাউন্সিলের সদস্যরা এক ধরনের ক্ষমতা লাভ করে ।

→ ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের পটভূমি : নিম্নে ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের পটভূমি আলোচনা করা হলো :

১. মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ : ১৭৫৭ সাল থেকে ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে ধীরে ধীরে ইংরেজি শিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে ভারতে ইংরেজী শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ ঘটে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই ভারতীয়দের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৮৯২ সালের আইন প্রবর্তিত হয় ।

২. ১৮৬১ সালের আইনের সীমাবদ্ধতা দাবিপূরণে ১৮৬১ সালের কাউন্সিল আইন প্রবর্তিত হলেও তা ভারতীয়দের মনের আশা পূরণে ব্যর্থ হয়। এই আইনের মাধ্যমে আইন সংক্রান্ত কাজের সাথে ভারতীয়দের সংযুক্তি। তবে এই আইনে গভর্নর জেনারেলকে অধ্যাদেশ তৈরির ক্ষমতা দিয়ে। আইনটিকে তার ইচ্ছাধীন পরিচালিত করতে সহায়তা করে। তদুপরি আইনসভা পরিষদগুলোকে পরিণত করা হয় কথার দোকানে। এছাড়া এই আইনে ভারতীয়দের মনোনয়নের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিধানও ছিল না ।

৩. ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসের ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয়দের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদেই ১৮৮৫ সালের সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সূচনা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ প্র সম্পর্ক স্থাপন, বর্ণ, ধর্ম, প্রদেশ নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের অ অনুভূতি ও মনোভাবের বিকাশ ও সংহতি সাধন সরকারের কাছে হ জনসাধারণের দাবি পেশ, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং জনমত গঠনে উদ্যোগী করাই হবে কংগ্রেসের লক্ষ্য। এছাড়া কংগ্রেসের মূল দাবি ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্ধারিত আইনে ভারতীয় সদস্যদের গ্রহণ করা।

৪. লর্ড ডাফরিনের ভূমিকা : জাতীয় কংগ্রেসের প্রচেষ্টাতে ইংল্যান্ডের উদারপন্থি সরকারের মতানুসারে এবং ব্রিটিশ ভারতের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লর্ড রিপন (১৮৮০-১৮৮৪) ১৮৮২ সালে ভারতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তদুপরি জনগণের দাবি পূরণের সম লক্ষ্যে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন কর বিতর্কিত বিষয় ও রিপোর্টসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৯৮২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন প্রণীত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিচেনা করা হলেও তা ভারতবাসীর পূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সমর্থ 'হয়নি। তবে এ আইনের বেশকিছু ত্রুটি থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এ আইনের দ্বারা ভারতীয়রা কতটুকু অধিকার লাভ করে তার উপর ভিত্তি করেই অধিকার আদায় একান্ত প্রয়াসী হয়ে উঠেন।

ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশদের শাসন নামক শোষণ নীতির কারণ ক্রমান্বয়ে জন অসন্তোষ দেখা যায়। না যার কারণে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহ ঘটে। অতঃপর ১৮৫৮ সালে। ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করা হলে সেখানেও ভারতবাসীর দাবিদাওয়ার প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা হয়। যার কারণে কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভারতীয় প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির জন্য ভারতীদের দাবি | জোরালো হয়ে উঠে। এমতবস্থায় ভারতীয় জনসন্তুষ্টির কারণে অনুসন্ধানের জন্য ভারতীয় আইনসভায় ভারতীয় সদস্য অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা এবং পূর্ববর্তী আইনসমূহের ভুলসমূহ দূর করার জন্য ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাশ করে।

— ১৮৬১ সালের আইনের ধারা বা বৈশিষ্ট্য : নিম্নে ১৮৬১ সালের আইনের ধারা বা বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :

১. ১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনে গভর্নর জেনারেলের পরিষদকে আরো সম্প্রসারণ করা হয়। এক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদ সদস্য সংখ্যা ৫ জনে উন্নীত করা হয়।

২. এ আইনে গভর্নর জেনারেলের পরিষদের কার্যাবলিকে সরাসরি দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। অর্থাৎ শাসন বিভাগকে আইন বিভাগ থেকে পৃথক করে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগে পরিণত করা হয় ।

৩. ১৯৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনে গভর্নর জেনারেলের শাসন বিভাগীয় কার্যাবলি পরিচালনার ভার সম্পূর্ণরূপে | গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদের উপর ন্যস্ত করা হয় ।

৪. এ আইনে ভারতীয় আইনসভার কাজকর্ম একমাত্র আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

৫. শাসন পরিষদের প্রশাসনিক কার্যাবলিতে এমনকি অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারেও আইনসভা কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না বলে স্থির করা হয়।

৬. আইন পরিষদ কর্তৃক পাসকৃত যেকোনো আইনকে প্রয়োজনবোধে নাকচ করার ক্ষমতা গভর্নর জেনালেকে দেয়া হয় ।

৭. সর্বোপরি ১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনে গভর্নর জেনারেল বা বড়লাটকে জরুরি পরিস্থিতিতে আইন পরিষদের অনুমোদন ব্যতিরেকেও অর্ডিন্যান্স বা জরুরি বিধি বা অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। তবে এ বিধি মাত্র ৬ মাসকাল বলবৎ থাকবে বলে এ আইনে উল্লেখ করা হয়।

৮. এ আইনে আইন বিষয়কে কাজের জন্য গভর্নর জেনারেলের পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৬ জনে উন্নীত করা হয়। এক্ষেত্র শাসন বিভাগের ৫ জন সদস্য ব্যতীত অতিরিক্ত একজন সদস্যকে আইন প্রণয়নের জন্য নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয় । তবে গভর্নর জেনারেল তার নিজস্ব বিচার-বিবেচনা মোতাবেক প্রয়োজনবোধে এ সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ১২ জনে উন্নীত করতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয় ।

৯. গভর্নর জেনারেলের সম্প্রসারিত পরিষদের অর্ধেক সদস্য বেসরকারি স্তর থেকে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হবে এবং এক্ষেত্রে কিছু মর্যাদাসম্পন্ন ভারতীয়কে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এ বেসরকারি সদস্যদের কার্যকাল হবে ২ বছর।

  ১০. ধর্ম, সরকারি ঋণ, সামরিক বিষয়, মুদ্রা, ডাক ও তার, দেশীয় রাজ্য প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইন পরিষদকে অবশ্যই গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন নিতে হবে। গভর্নর জেনারেলের সম্মতি ব্যতীত কোনো বিলই আইনে পরিণত হবে না। তবে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের পূর্বানুমতি না নিলেও চলবে।

১১. এ আইনে বলা হয় যে, আইনসভা বা আইন পরিষদ আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না নিলেও চলবে। কর্তৃক প্রণীত আইনকে অবশ্যই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পাসকৃত

১২. মুম্বাই এবং মাদ্রাজ সরকারের আইন প্রণয়ন বিষয়ক ক্ষমতার পুনরুদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ এ আইনে মাদ্রাজ ও মুম্বাই পরিষদের উপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পুনরায় অর্পণ করা হয়।

ব্যবস্থাপক সভা গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৩. বাংলা, পশ্চিম প্রদেশে ও পাঞ্জাবে আইন পরিষদ বা

১৪. মাদ্রাজ ও মুম্বাইয়ের গভর্নর্দের কাউন্সিল বা পরিষদ ও এ আইনের দ্বারা সম্প্রসারিত হয়। এক্ষেত্রেও কিছু মর্যাদাসম্প ভারতীয়কে বেসরকারি সদস্যপদ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়।

১৫. এ আইনে প্রাদেশিক আইন পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব বা বলে উল্লেখ করা হয় । বিলসমূহ গভর্নরের অনুমোদন সাপেক্ষে আইনে পরিণত হবে।

১৬. সকল প্রাদেশিক আইনগুলো সংশোধন, মূলতুবি, ভেটো বা রদ করার ক্ষমতাও গভর্নর জেনারেলের উপর অর্পণ করা হয়।

১৭. এ আইনের দ্বারা ভারত সরকারের শাসন কার্যের সুবিধার জন্য ' পোর্ট ফোলিও' (Port folio) 'দপ্তর বণ্টন রীতি প্রবর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক শাসন পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বণ্টিত বিশেষ কিছু বিষয় নির্বাহের ক্ষেত্রে সদস্যরা গভর্নর জেনারেলের নির্দেশ অনুসরণ করবে বলে স্থির করা হয়।

১৮. গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদের সম্প্রসারিত সদস্যদের সম্পর্কে নতুন নীতি গৃহীত হয়। এক্ষেত্রে পঞ্চম সদস্যকে অবশ্যই বিশেষভাবে আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকার হবে বলে উল্লেখ করা হয়। অধিকন্তু অন্যান্য ৪ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত ৩ জনকে ভারতবর্ষে ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে বলা হয় ।

আইনের তাৎপর্য/গুরুত্ব  ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ইতিহাসে ১৮৬১ সালের : ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ইতিহাসে ১৮৬১ সালের আইন অনেক পরিবর্তন আনে। ১৮৬১ সালের আইনের মাধ্যমে লর্ড ক্যানিং সরকারের কাজ কর্ম বিভিন্ন দফতরে বিভক্ত করে কাউন্সিলের এক একজন সদস্যর উপর একটি ভার অর্পণ করে ভারতীয় শাসনব্যবস্থার কেবিনেট প্রথা চালু করে। কাউন্সিলে কিছু সংখ্যক ভারতীয়কে গ্রহণ করে এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোকে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করে এ আইন ভারতীয়করণ ও বিকেন্দ্রীয়করণের পথ প্রশস্ত করে এবং স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি রচনা করে। এছাড়া এ আইনে দপ্তর বণ্টন ন | রীতি প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় কেবিনেট প্রথার প্রচলন শুরু হয়। ১৮৬১ সালের আইনের মাধ্যমে কিছুসংখ্যক = ভারতীয়কে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে ভারতীয়দের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের তীব্রতর হয়ে উঠে এবং ভারতীয়া রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে । যার কারণে এ আইন = | প্রকৃত পক্ষে বেশ গুরুত্ব বহন করে। ১৮৬১ সালের আইনের মাধ্যমে গভর্নর জেনারেলের পরিষদকে আরো বেশি সম্প্রসারণ করা হয়। তাছাড়া ১৮৬১ সালের আইনে গভর্নর জেনারেলের শাসন বিভাগীয় কার্যাবলি পরিচালনার ভার সম্পূর্ণরূপে গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদের উপর ন্যস্ত করা হয়।

গভর্নর জেনারেলের সম্প্রসারিত পরিষদের অর্ধেক সদস্য বেসরকারি স্তর থেকে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হবে এবং এক্ষেত্রে কিছু মর্যাদাসম্পন্ন ভারতীয়কে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে লক্ষ্য করা যায় এ আইনে মাত্র কয়েকজন ভারতীয়কে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক আইন পরিষদে মনোনীত করায় ভারতীয়দের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের দাবিমূলত অপূর্ণ থেকে যায়। কেননা এখানে সরকারি সদস্যদের সংখ্যাধিক রেখে বেসরকারি সদস্যদের মতামতকে জলাঞ্জলি দেয়া হয় । এছাড়া বেসরকারি সদস্যদের অধিকাংশ সরকারের মনোনীত হওয়ায় তাদের পক্ষে সরকার বিরোধী কোনো মতপ্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

তাছাড়া কোনো আইন চূড়ান্ত করার অধিকার আইন পরিষদকে দেয়া হয়নি, বরং সকল আইন গভর্নর জেনালের সম্মতি সাপেক্ষে পাস করার রীতি গৃহীত হয়। যার কারণে বলা হয়ে থাকে এ আইন ছিল যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া এ আইন ভারতীয়দের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। কেননা এ আইনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের পরিধি বৃদ্ধি করার কোনো চেষ্টাও করা হয়নি।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন ছিল একদিকে ভারতীয়দের জোরালো দাবিদাওয়া এবং অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের সতর্কতামূলক সচেতনতার মধ্যে এক সাংবিধানিক সমন্বয়। এ আইনের কিছু দোষত্রুটি থাকলেও এ আইনের মাধ্যমে ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কিছুসংখ্যক সদস্যের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করায় ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণির উত্তরোত্তর রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করার একটি সুযোগ হয়।

ভূমিকা উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। উপমহাদেশের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ধারায় এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিদ্রোহ ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তারা ভারতে । বিদ্রোহের জন্য কোম্পানিকে দায়ী করে এবং ভারত শাসন আইন। প্রণয়ন করে । অন্যদিকে তীব্র বিরোধিতা করেন।

ভারত শাসন আইনের ধারা : ভারত বর্ষের ইতিহাসে ভারত শাসন আইন একটি অতীব গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় । নিয়ে ভারত শাসন আইনের প্রধান প্রধান ধারাসমূহ আলোচনা করা হল :

১. ব্রিটিশ রাজ্যের ক্ষমতা : ভারত শাসন আইনে ভারত শাসনের ক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজ্যের হাতে। অর্পিত হয়। ফলে এখন থেকে ভারত মহামান্য রানির নামে কে শাসিত হবে। এ আইন বলে ইংল্যান্ডের রাজা বা রানি আ কোম্পানির স্থল ও নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হল ।

২. বোর্ড অফ কন্ট্রোল ও ডিরেক্টর সভার বিলোপ : ভারত শাসন আইনে বোর্ড অফ কন্ট্রোল এবং ডিরেক্টরস সভার বিলোপ সাধন করা ধ হয় এবং এর দায়িত্বসমূহ ভারত সচিব ও তার ভারত পরিষদ এর ইং হাতে অর্পণ করা হয় । ভারত সচিব ইংল্যান্ডের রাজারা বা রানির নামে ভারতের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন বলে স্থির হয় ।

৩. কাউন্সিল গঠন : ভারত সচিবকে সাহায্য করার জন্য ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। এই ১৫ জনের মধ্যে ৮ জন ব্রিটিশরাজ কর্তৃক নিযুক্ত এবং ৭ জন ডাইরেক্টরস সভা কর্তৃক নির্বাচিত হন। আইনে উল্লেখ আছে যে, কাউন্সিলের অন্তত ৯ জন সদস্য ভারত সম্পর্কে অভিজ্ঞ হবেন ।

৪. শূন্য আসন পূর্ণ : ভারত সচিবের কাউন্সিলে ডিরেক্টরদের মনোনীতি কোনো সদস্যপদ শূন্য হলে রাজা বা রানি কর্তৃক তা পূরণ হবে। কাউন্সিলের সদস্যগণ সদাচরণকাল পর্যন্ত নিজ নিজ পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন। পার্লামেন্টের সুপারিশকল্পে রাজা বা রানি কর্তৃক তারা অপসারিত হবেন।

৫. বেতন ভাতা : এ আইনে কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্যকে ভারতীয় রাজস্ব থেকে বার্ষিক ১২০০ পাউন্ড বেতন দেয়া হবে। কাউন্সিল প্রতি সপ্তাহে একবার মিলিত হবে। ৫ সদস্যের উপস্থিতিতে বৈঠকের কোরাম হতো।

৬. ভারত-সচিবের ক্ষমতা : ভারত সচিব কাউন্সিলের সবঅধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। কোনো বিষয়ে কাউন্সিল সমান দুভাগে বিভক্ত হলে সেক্ষেত্রে ভারত সচিব অতিরিক্ত ভোট দিতে | পারবেন। তার অনুপস্থিতিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার হলে তার লিখিত অনুমোদন প্রয়োজন ছিল ।

৭. ভারত-সচিবের স্বাক্ষর : ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারত সরকারের স্বাক্ষর পাঠানো হতো। অনুরূপভাবে ভারত সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রেরিত সকল চিঠিপত্রে ভারত সচিবের নামে প্ররিত হতো।

৮. অধিবেশনে সভাপতিত্ব : ভারত সচিবকে তার অনুপস্থিতিতে কাউন্সিলের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য হতে একজন সহ-সভাপতি নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।

৯. বার্ষিক বিবরণ : ভারত সচিবকে পার্লামেন্ট ভারতের রাজস্ব ও ব্যয় সম্পর্কে বার্ষিক বিবরণী পেশ ও ভারতীয়দের নৈতিক ও বৈষয়িক অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান করা হতো।

১০. সিভিল সার্ভিস : ভারত শাসন আইনে ভারতের সিভিল সার্ভিস সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান তৈরির দায়িত্ব ভারত সচিবের উপর অর্পণ করা হয় ।

১১. কোম্পানির উত্তরাধিকার : ভারত শাসন আইনে কোম্পানির সমস্ত চুক্তি, আদান-প্রদান, দায়-দায়িত্ব কোম্পানির উত্তরাধিকার হিসেবে ভারত সচিবের উপর অর্পিত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৫৮ সালের কোম্পানির শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন পাশ করেন। কোম্পানি সরকার এদেশের জনসাধারণের উপর যে অত্যাচার নির্যাতন করতো এ আইনের মাধ্যমে তা কিছুটা লোপ পায়। ভারতীয় জনগণ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পায় । । ধর্মীয় সহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করা হয়। দেশীয় নৃপতিদের সাথে র ইংরেজ শাসকদের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভূমিকা : চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইন হলো ব্রিটিশ সরকারের সাথে কোম্পানির চুক্তি। কোম্পানি কর্মচারীদের দুর্নীতি অভিযোগের প্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম ১৭৯৩ সালে সনদ আইন পাস হয়। ১৭৯৩ সালের সনদ আইনের ২০ বছর পূর্ত হলে ১৮১৩ সনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পুনরায় সনদ আইনের দাবি উঠে। ফলে ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ২য় সনদ আইন পাস হয় ।

১৮১৩ সালের সনদ আইনের ধারাসমূহ/ বৈশিষ্ট্যাবলি : ১৮১৩ সালের ধারা বা বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো :

১. উন্মুক্ত বাণিজ্যের অনুমোদন : ১৮১৩ সালের আইনে ইংল্যান্ডের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের জন্যও উপমহাদেশে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ করে দেয়। ইতোপূর্বে এখানে কোম্পানি একচেটিয়াভাবে বাণিজ্য করতো। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও ছিল। যেমন- চা বাণিজ্যে কোম্পানির একক আধিপত্য করতো ।

২. মিশনারী কার্যক্রমের অনুমোদন : ১৮১৩ সনের সনদ আইনে ভারতীয় উপমহাদেশে মিশনারীদের আগমন অনুমোদন দেয় এবং একই সাথে এখানে মিশনারী কার্যক্রমের অনুমতি দেয়। এর ফলে খ্রিস্টান মিশনারীরা উপমহাদেশে ব্যাপকহারে আগমন করে এবং এখান খ্রিস্টধর্মের প্রচার কাজ করে ৷

৩. কোম্পানির রাজস্ব ব্যবহার নীতি : এ সনদে ভারত থেকে সংগৃহীত রাজস্ব কোন খাতে কীভাবে ব্যবহার করবে তা = উল্লেখ করা আছে। এ রাজস্ব থেকে সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, = | কোম্পানির ঋণবাবদ সুদ পরিশোধ এবং ভারতীয় কোম্পানির সমস্ত বেসামরিক ও বাণিজ্যিক ব্যয় নির্বাহের খরচ বহন করবে।

৪. গভর্নর জেনারেল ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা : এ আইনে গভর্নর জেনারেল ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেয়া এবং বাতিল করার ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল ও স্থানীয় সরকারের অবাধ হস্তক্ষেপের ক্ষমতা দেয়া হয় ।

৫. ভৌগোলিক বিবরণ সংরক্ষণ : এ অঞ্চলে অবাধে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুবিধার্থে কোম্পানিকে বাণিজ্যিক ও ভূখণ্ডগত বিবরণ আলাদাভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয় ।

৬. বোর্ড অব কন্ট্রোলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : এ আইনে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতাকেন্দ্রিক প্রেসিডেন্সিগুলোতে Board of Control-এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

৭. Justice of peace নিয়োগ : এ আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো Justice of peace নিয়োগ । ভারতে কোনো ব্রিটিশ কর্মচারী যদি অপরাধ করে তার বিচারের জন্য ব্রিটেনে আলাদা আদালত স্থাপন করা হয় এবং সেখানে তাদের বিচার হয় ।

৮. সামরিক বিষয়াবলি সম্পর্কে ধারা : ১৮১৩ সালের সনদে সামরিক বিষয়াবলির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়। এই সনদে কোম্পানি ও ভারতীয় প্রশাসনের সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ প্রণয়ন বিশেষ নিয়মকানুন প্রণীত হয়। যা কোম্পানির পরিচালনাকে নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৯. কোম্পানির কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ : এ আইন কোম্পানির কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে । এই পদক্ষেপ কোম্পানির কর্মচারীদের দক্ষ ও নিপুণ করে গড়ে তোলে । কোম্পানির প্রশিক্ষণ ও সংগঠনের প্রভাবে দক্ষ এক শ্রেণির কর্মচারী গড়ে তোলে যারা ভারতীয় প্রশাসনে বিশেষ ভূমিকা বিস্তার করে ।

১৮১৩ সালের সনদ আইনের গুরুত্ব : নিম্নে ১৮১৩ সালের সনদ আইনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. চা ব্যবসায় একচেটিয়া অধিকার লাভ : ১৮১৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা ব্যবসায় একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। যা পরিচালিত হতো চীন সাম্রাজ্যের সাথে এবং বিভিন্ন দেশে। যার ফলে এ কোম্পানি অধিক পরিমাণ মুনাফা অর্জনের সুযোগ লাভ করে।

২. বোর্ড অব কন্ট্রোলের ক্ষমতা বৃদ্ধি : ১৮১৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে বোর্ড অব কন্ট্রোলের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয় । রাজকীয় ফরমান ও সনদ প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় বোর্ড অব কন্ট্রোল । এছাড়া বলা হয়, বোর্ড অব কন্ট্রোলের অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়ে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস সভা গভর্নর জেনারেল, গভর্নর ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে নিযুক্ত করবে এবং ছোট পদগুলোতেও এ বোর্ড নিয়োগ দিবে |

৩.সামরিক কর্মচারীদের  উন্নত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা:১৮১৩ সালের সনদের তার কোম্পানির সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের বৈশিষ্ট উন্নত প্রাশক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সামরিক কর্মচারীদের জন্য 'Military Seminary at Aberombic'-তে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং বেসামরিক কর্মচারীদের 'Hailybury College' এ কমপক্ষে ৪ টার্ম পড়াশোনার নির্দেশ প্রদান করা হয়। তা না করলে চাকরি দেওয়া হতো না। যার ফলে ধীরে ধীরে কোম্পানির সকল কর্মচারী দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে।

৪. ভারতে ইউরোপীয় বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা : কোম্পানির সনদ প্রদানের পর কোম্পানি তার পরিশোধের জন্য অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আদায় । মাত্ৰা করতো। এছাড়া কোম্পানির সদস্যরাও অনেক সময় বিভিন্ন আইে দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ত। এজন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতে ইউরোপীয়দের বিচারের জন্য 'Justice of Peace' পদে একজন মূলত ইউরোপীয় বিচারক নিয়োগ করেন। যার কাছ ছিল কোম্পানির ব্যব কাছ থেকে সঠিক সময়ে ঋণ আদায় করা এবং অবৈধ প্রবেশ, অবমাননা, দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাদের বিচার করা।

৫. ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধি : ১৮১৩ সালের সনদের পর নির্দিষ্ট আইন থাকায় ইউরোপীয় অন্যান্য বণিক শ্রেণি এবং অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে ভারতে। কারণ ব্রিটিশ সরকার সকল ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ের ব্যবস্থা করে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এতে বিদেশি পুঁজি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবাধ প্রবেশ ঘটে ভারতে। যা ভারতীয়দের ও ব্রিটিশদের হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে ।

৬. শিক্ষা বিস্তার : ১৮১৩ সালের সনদের মধ্যে ভারতীয় শিক্ষা অ ব্যবস্থাকে উন্নত করার ব্যবস্থা করা হয় এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পথকে প্রশস্ত করা হয়। এর একটি মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় ১ প্রশাসনের নিম্ন পদগুলোতে ভারতীয়দের নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমেই তাদেরকে শাসনের পথ তৈরি করা। এ কারণে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয় ।

৭. ভারতে ইংরেজ বসতি গড়ে তোলা : ১৮১৩ সালের সনদের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতে কোম্পানিতে চাকরিরত কর্মচারীদেরকে ভারতে জমি ক্রয়-বিক্রয় ও বসতি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা হয়। যার ফলে ইংরেজরা আগ্রহী হয়ে কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিতে থাকে। এতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের জন্য কলোনি স্থাপিত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট ভারতে শাসনতান্ত্রিক সুশাসন এবং কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২০ বছর সনদ প্রদানের কথা বলা হয়। আর ১৮১৩ সালের সনদ আইন প্রণয়ন ভারতীয় উপমহাদেশে কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকারের কার্যপ্রণালি এই আইন দ্বারা গৃহীত হয়।

অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে লিখ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল এবং কুফল আলোচনা কর।

ভূমিকা : ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভের কূটকৌশলে বাংলার দিওয়ানি লাভের পর একই বছর দ্বৈতশাসন চালু করেন। আর এই দিওয়ানি ও দ্বৈতশাসনের ফলে ১৭৬৯-৭০ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে বিপর্যস্ত বাংলাকে রক্ষার জন্য ডাইরেক্টর সভা ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলায় গভর্নর করেন। তিনি পঞ্চসালা বন্দোবস্ত করলেও তা ব্যর্থ হয়। ফলে ১৭৮৫ সালে ডাইরেক্টর সভা লর্ড কর্ণওয়ালিশকে বাংলার গভর্নর করে পাঠান। তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। আর প্রকৃতির নিমানুযায়ী এই বন্দোবস্তের এ ভালো ও মন্দ দিক ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

→ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম বিমূর্ত ধারণা দেন আলেকজাণ্ডার দত্ত ও হেনরি পেট্রলো, পরে তাদের এই ধারণার আরো বিকাশ সাধন করেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। ফিলিপের পরিকল্পনায় ভর করে ব্রিটিশ সরকার ১৭৮৪ সালে Pitt india act করেন আর এই আক্টের ৩৯ নং ধারায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। পরে কাউন্সিলর চার্লস স্টুয়ার্ড এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন কিন্তু তখন তা ব্যর্থ হয়। পরে ১৭৮৬ সালে কর্ণওয়ালিশ গভর্নর হয়ে এসে ভূমি রাজস্বের চিরস্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করেন এবং কাউন্সিল সভার অনুমতিক্রমে ১৭৯০ সালে দশশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন এবং সহজ, এই ঘোষণা ও দেন যে, যদি কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা এই দশশালা বন্দোবস্তের অনুমোদন দেন তবে তিনি তাকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা দিবেন। অবশেষে ১৭৯৩ সালে ডাইরেক্টর সভা অনুমতি দিলে কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ৷

নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো :-

১. রাজস্ব আয় ও বাজেট সম্পর্কে ধারণা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান সুবিধা ছিল এর ফলে কোম্পানির রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং বাৎসরিক বাজেট প্রস্তুতের সুবিধা হয় ।

২. প্রজাদের উন্নতি : কোম্পানি থেকে জমিদারগণ জমির মালিক হওয়ায় প্রজাসাধারণের উপকার হয়। কারণ জমিদাররা স্থানীয় হওয়ার তারা প্রজাদের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বিদ্যালয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন ।

৩. কুঠির শিল্পের উন্নতি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাভ করার ফলে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের কুঠির শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় |

৪. নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সুর্যাস্ত আইনের কোপানলে পড়ে অনেক পুরাতন জমিদার তাদের জমিদারি হারায় । ফলে অনেক নতুন নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। ৫. কর্মচারীদের দক্ষতাবৃদ্ধি : রাজস্ব আদায়ে কোম্পানির কর্মচারীরা ছিল পুরোপুরি ব্যর্থ। কারণ তাদের বাংলার রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ফলে তারা ব্রিটিশের রাজস্ব নীতি বাংলায় প্রয়োগের চেষ্টা করলে একই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানরি কর্মচারী এই বিপর্যয় আরো দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়।

=> নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো :- ১. পুরাতন জমিদারি বিলুপ্তি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সূর্যাস্তের আইনের ফলে অনেক জমিদার পরিবার নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ জমা না দিতে পারায় তারা বিলুপ্তি হয়ে যায় ।

২. রায়তের ওপর অত্যাচার : জমিদারগণ যেমন সরকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার শর্ত জমি ভোগ দখলের স্থায়ী অধিকার পায়, তেমনি তারা ও রায়তদের অনুরূপ শর্তে রায়তদের জমি বন্দোবস্ত দেবেন। কিন্তু এই শর্ত লংঘন করে জমিদাররা ঠুনকো অজুহাতেই রায়তদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত।

৩. রাজস্ব নির্ধারণে ত্রুটি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে অধীনে কি পরিমাণ জমি নিষ্কর ছিল। কি পরিমাণ জমিতে পশুচারণ ছিল তা খোজখবর না দিয়ে রাজস্ব নির্ধারণ করার ফলে রাজস্বের মাত্রা বেশি হয়েছিল। এতে জমিদারদের কাছ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তাই ছিল একমাত্র ভিত্তি। ফলে রাজস্বকে কেন্দ্র করে প্রচুর মামলা মকদ্দমার সৃষ্টি হয়।

৪. সরকারের আর্থিক ক্ষতি : ১৭৯৩ সালে জমির যে মূল্য | ছিল এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু তাতে সরকারের নির্দিষ্ট রাজস্বের কোনো বৃদ্ধি হয় নি।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ১৭৯৩ সালের যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন তা ছিল অনেকটাই যুগোপযোগী ও জনকল্যাণমুখী । এই ব্যবস্থার ফলে ভূমি রাজস্বে স্থিতিশীলতা আসে। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কিছু অসুবিধা তথা কুফল ছিল।

ভূমিকা : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে পরাজিত করেন। এরপর ১৭৬৪ সালে বক্সারের প্রান্তরে বাংলা, অযোধ্যা ও মুঘল সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে তারা বাংলার রাজনীতিতে এক প্রবল প্রতাপশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা এখন বণিকের ছদ্মবেশ ফেলে দিয়ে শাসকের রাজদণ্ড হাতে তুলে নেয়। কিন্তু ধূর্ত ইংরেজ গভর্নর লর্ড ক্লাইভ বাংলার শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি নিজ হাতে তুলে না নিয়ে মুঘলদের সাথে এক যৌথ শাসন প্রবর্তন করেন, যা ইতিহাসে এ্যাংলো মুঘল শাসন হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে ।

→ এ্যাংলো-মুঘল যৌথশাসন : ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ ছিল কোম্পানির একটি ছলনামাত্র। এরপর পুতুল নবাব মির কাশিমকে সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু মির কাশিম ছিলেন স্বাধীনচেতা ও দেশ প্রেমিক । ফলে ইংরেজদের সাথে তাকে বিরোধে জড়াতে হয় । কিন্তু মুক্তের ও পাটনা যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। এরপর ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মির কাশিম, সুজা-উদ-দৌলা ও সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সম্মিলিত বাহিনী চূড়ান্ত পরাজয়বরণ করলে বাংলায় শাসন ক্ষমতা তখন কোম্পানির হাতে চলে যায়। কিন্তু কোম্পানির কৌশলগত কারণে উক্ত ক্ষমতা সরাসরি গ্রহণ করেন নি। কারণ শাসন ক্ষমতা পরিচালনার মত লোকবলের অভাব, স্থানীয় ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে তারা মুঘল সামনে রেখে নিজেরা যে শাসন পরিচালনা করেছিল তাই ইতিহাসে এ্যাংলো-মুঘল শাসন নামে বিখ্যাত

এ্যাংলো-মুঘল যৌথশাসনের প্রকৃতি কোম্পানি বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানি লাভ করে। কিন্তু অত্র অঞ্চলের রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার জন্য তারা রেজা খান মুহাম্মদকে বাংলা ও বিহার আর সিতাব রায়কে উড়িষ্যার নায়েবে দিওয়ানি নিযুক্ত করেন। তিনি বাংলার নাবালক নবাব নিজামউদ্দিনের অভিভাবক মনোনীত হন। ফলে দিওয়ানি শাসন ও নিযামতের উভয় দায়িত্ব এখন রেজা খানের উপর অর্পিত। কিন্তু এতদসত্ত্বে ও তিনি পুরোপুরি স্বাধীন ছিলেন না। নিয়ামত ও দিওয়ানের ব্যাপারে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তাকে কোম্পানির অভিমত নিতে হতো। তাই স্বাধীন হলেও পরোক্ষভাবে তিনি কোম্পানির অধীনস্তই থেকেই যান। এ পর্যায়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭৬৯ সালের আগষ্ট মাসে প্রতি জেলায় করে ইংরেজ সুপারভাইজার নিয়োগ করেন । সুপারভাইজারদের দুটি প্রধান দায়িত্ব ছিল।

১. রেজা খানের পক্ষ হয়ে দেখা যে, কোম্পানির কর্মচারীরা অন্যায়ভাবে সরকারি আইন লঙ্ঘন বা কোনো অত্যাচারে লিপ্ত কি-না।

২. কোনো সরকারি আমলা অন্যায়ভাবে কোম্পানির ব্যবসায়ে বাধার সৃষ্টি করছে কিনা, বস্তুত সুপারভাইজারের কোনো ক্ষমতা ছিল না, তাদের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে কাউন্সিলকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করা ।

→ এ্যাংলো-মুঘল শাসনের ফলাফল : এ্যাংলো-মুঘল শাসনব্যবস্থা কোম্পানির জন্য আশীর্বাদ হলেও তা বাংলার জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।

১. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি : এ্যাংলো-মুঘল শাসনব্যবস্থার ফলে বাংলার শাসনকাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। কারণ এই ব্যবস্থায় নবাবের কোনো সামরিক বাহিনী না থাকা স্বত্ত্বেও তার উপর দেশের আইন-শৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্ব ছিল। ফলে পর্যাপ্ত অর্থ ও লোকবলের অভাবে নবাব এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে রেজা খান রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে যথেষ্ট তৎপরতা দেখালেও আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখান।

২. রাজস্বের হার বৃদ্ধি : এ্যাংলো-মুঘল শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে কোম্পানির নায়েব সুজা ও অন্যান্য কর্মচারীরা কোম্পানি বাহাদুরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কারণ এর উপরই তাদের চাকুরীর স্থায়িত্ব নির্ভর করতো। ফলে তারা নির্যাতন ও নিপীড়ন করে কৃষকদের থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের ব্যস্থা করেন |

৩. বাংলার সম্পদ পাচার : ১৭৬৫ সালের দ্বৈত শাসনের পূর্বে কোম্পানির উদ্দেশ্যে ছিল এদেশে বাণিজ্য করে মুনাফা অর্জন করা কিন্তু দ্বৈত শাসনব্যবস্থার পর তারা শাসন ক্ষমতার একচ্ছত্র শক্তি হয়ে এদেশের সম্পদ ব্রিটেনে পাচার করা শুরু করে।

৪. প্রাইভেট বিজনেস : যৌথ শাসনব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কোম্পানির কর্মচারী ব্যক্তিগত বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। তারা সরকারি দস্তকের অপব্যবহার করে সমগ্র রাজ্যে শুল্ক ছাড়া অবাধ বাণিজ্য পরিচালনা করতে থাকে। ফলে দেশীয় ও অন্যান্য বণিকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্বখীন হন |

৫. কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য : দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কোম্পানির রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার ফলে এদেশে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করেন।

৬. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর : এ্যাংলো-মুঘল শাসনব্যবস্থার নির্মম পরিণতি ছিল ১৭৭০ সালের (১১৭৬) মারাত্মক ছিয়াত্তরের মন্থত্ত্বর । অনাবৃষ্টির কারণে সে বছর ফসল উৎপাদন হয় নি, কিন্তু কোম্পানির রাজস্ব কর্মচারীরা নিপীড়ন অত্যাচার চলিয়ে কৃষকদের সর্বাস্ব কেড়ে নিলে সারা দেশে দেখা দেয় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ছিয়াত্তরের এই মন্বন্তরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ১৭৬৫ সালে প্রবর্তিত এ্যাংলো-মুঘল শাসন ছিল কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণমূলক একটি শাসনব্যবস্থা। এর ফলে কোম্পানি আর্থিকভাবে লাভবান হলেও বাংলার আইন-শৃঙ্খলা ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যার করুণ পরিণতি ছিল ১৭৭০ সালে সংঘটিত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ।

ভূমিকা : ১৯৪৬ সালের মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় ভারতবাসীর জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফলতার মুখ দেখেনি। ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এটলির ঘোষণায় ভবিষ্যৎ সংবিধান নিয়ে আলোচনার জন্য একটি মিশন পাঠানো হয়। এ মিশনের সদস্যরা হলেন- ভারত সচিব লর্ড প্যাথিক লরেনস, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এ.ডি আলেকজেন্ডার, এ মিশন যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার ঐক্যমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে এ পরিকল্পনার ঘোষণা দেয় । তবে এ মিশন সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি ।

→ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ব্যর্থতা : ১৯৪৬ সালের ১৬ জুন | বড়লাট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সম্পর্কে নিজেদের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সমান সংখ্যাক সদস্যপদ দানে সম্মত হয়। এ ঘোষণার পর মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে লর্ড ওয়াভেল পূর্ব চুক্তি রক্ষা করতে পারেনি। | মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাব | সংবলিত। এদিকে কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি জহরলাল নেহেরু ক্যাবিনেট মিশনে যোগদানের কথা বলেন। অন্যদিকে ২১ জুলাই বড়লাট ওয়াভেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের জন্য নেহেরু ও জিন্নাহকে আমন্ত্রণ জানান। মুসলিম লীগ নেহেরুর বিবৃতির পর মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন। তখন কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অবশ্য এ প্রস্তাব লর্ড ওয়াভেলের পক্ষ থেকে আসে। এর প্রতিবাদস্বরূপ মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস ঘোষণা করেন। ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়। ফলাফল স্বরূপ মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠিত হয়। নিজেদের কল্যাণের উদ্দেশ্য কিন্তু এ সরকার বাস্তবে অকার্যকর রয়ে যায়। সবখানে মুসলিম লীগের অসহযোগীতায় একটি অচল অবস্থা সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস প্রদেশের গ্রুপিং ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারে না। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার উভয়কেই নিয়ে একটি ভারতীয় বৈঠকের আহ্বান জানান। যদিও ব্রিটিশ সরকারের আহ্বানে পরবর্তীতে গণপরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হয় কিন্তু মুসলিম লীগ এ আহ্বান সাড়া দেয় না। ফলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে দাঙ্গা-দাঙ্গামা পারস্পরিক সন্দেহ আরো মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করে। আর এই অশান্তময় অবস্থায় মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা | মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তথা ভারতবাসীর জন্য একটি কল্যাণকর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তবে এ পরিকল্পনার মধ্যে ভারত বিভক্তির বীজ নিহিত ছিল বলা যায় ।

ভূমিকা : ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতের ইতিহাসে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে ও ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করা হয়। এ আইন ভারতীয় নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৩৫ সালের ২৪ জুলাই পাস করা হয়। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ।

— ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি : এ আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব। এ আইন প্রণয়নের পূর্বে ভারতীয় শাসনব্যবস্থা ছিল এককেন্দ্রিক। শাসনব্যবস্থাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রদেশগুলোকে একত্র করে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা করা হয় এ আইনের মাধ্যমে ।

২. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এ আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

৩. দ্বৈতশাসন প্রবর্তন : ১৯৩৫ সালের ভারত আইনের মাধ্যমে কেন্দ্র দ্বৈতশাসনের ব্যবস্থা হয়। এ আইনের মাধ্যমে প্রদেশসমূহ থেকে দ্বৈতশাসন রহিতকরণ করা হয় ।

৪. দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা । আইনসভার উচ্চ কক্ষের নাম রাষ্ট্রীয় সভা ও নিম্ন কক্ষের নাম ব্যবস্থাপক সভা ।

৫. নতুন প্রদেশ : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে দুটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। যথা- সিন্ধু ও উড়িষ্যা প্রদেশ। এমনকি এ আইনের মাধ্যমে বার্মাকে ভারত থেকে পৃথক করা হয় ।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সাইমন কমিশন ও গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার আলোকে প্রবর্তিত এ আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা । যা ভারতবর্ষের শাসনতন্ত্রকে খুবই গতিশীল করে তোলে |

ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবাসীর সাহায্য সহযোগিতার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতেই ১৯১৯ সালে ভারতে যে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থায় প্রবর্তন করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা কার্যকরী হয়নি। তাই জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। ফলে, সরকার তাৎক্ষণিক কিছু দমনমূলক আইন পাস করে ।

→ রাওলাট অ্যাক্ট:দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত

ভারতীয়দের উপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার ভারতবাসীকে ক্ষুদ্ধ অথবা করে তোলে। ফলে এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত হয় এবং ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাস সবকিছু দমন বা সশস্ত্র আন্দোলন পুনরায় সংঘঠিত হতে শুরু করে। খলিফা এমতাবস্থায় ভারত সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং যুগে ভারতীয়দের সকল প্রকার রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করতে ইতিহা নতুন এক আইন প্রণয়নের প্রয়োজন অনুভব করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বড় লাটের আইন সচিব স্যার সিডনি রাওলাটকে শব্দের সভাপতি করে একটি কমিটি ভারতে প্রেরণ করা হয়। এ কমিটি | প্রতিনি সরজমিনে অবস্থা তদন্ত শেষে দু'ধরনের আইন প্রণয়নের | এখাে সুপারিশ করে রিপোর্ট পেশ করে। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার দুটি বিল তৈরি করে এবং ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় আইন সভায় বিল দুটি পাস হয়। কমিটির সভাপতির কিছু নাম হিসেবে এ আইন রাওলাট নামে পরিচিত। এ আইনের আওতায় যে দুটি বিল পাস হয় তা হলো নিম্নরূপঃ

১. প্রথম রাওলাট বিলে রাজবিদ্রোহ মামলা বিচার করার জন্য নতুন একটি বিচারালয় গঠনের প্রস্তাব করা হয় ।

২. দ্বিতীয় রাওলাট বিলে রুদ্ধদ্বার আদালত সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিনা উকিলের সাহায্যে বিচার করে অভ্যন্তরীণ বা বিনা বিচারে আটক করে রাখার ব্যবস্থা করা হয় ৷

→ প্রতিক্রিয়া : এ আইনের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মলিব্য ও মাজহার- উল- হক আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন এবং ভাইসরয়ের নিকট লিখিত এক প্রতিবাদ পত্রে জিন্নাহ মন্তব্য করেন যে, এ আইনের দ্বারা ন্যায়বিচারের মূল আদর্শ ধ্বংস করা হয়েছে এবং যে | হি সমস্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না সে সময় জনগণের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে ।

সমালোচনা : এ আইনের সমালোচনা করে গান্ধী বলেছেন- আপিল নেই দলিল নেই উকিল নেই এবং এ আইনের প্রতিবাদে তাঁর ডাকে ১৯১৯ সালের ১৩ মার্চ দেশ ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং স্থানে স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। পরে আন্দোলন দমন করার জন্য ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। অমৃতসরের শাসনকর্তা জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করে। ফলে সমগ্র দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায যে, রাওলাট আইন ছিল ব্রিটিশ সরকারের শোষণের হাতিয়ার। যে হাতিয়ার প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের উপর অত্যাচার নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছিল এবং অগণিত নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করেছিল। তবে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা দিয়েছিল।

ভূমিকা : রাজনৈতিক সংকট নিরসনে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে তাদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, আর এটাই বা এই চুক্তিই ইতিহাসে বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তি নামে পরিচিত। এটা মূলত ১৯২০ সালে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলে নতুনভাবে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। আর এ সমস্যা সমাধানের জন্যই মূলত একটা রাজনৈতিক চুক্তি করা হয় আর এটাই বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তি নামে পরিচিত।

→ বেঙ্গল প্যাক্ট : ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন বেঙ্গল প্যাক্ট তাদের জন্য আশার আলো বয়ে আনে যার নেতৃত্ব দেন চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি মুসলমানদের সহযোগিতা লাভের আশায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসেন। তিনি মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চিত্তরঞ্জন দাসের লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে হিন্দুদের সমকক্ষ করা। আর এ কারণেই তিনি সমঝোতায় আসেন এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন। যা ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত এ রাজনৈতিক চুক্তিই ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট নামে অভিহিত হয়।

→ ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের শর্ত/ধারাসমূহ : ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট বা বঙ্গীয় চুক্তির প্রধান প্রধান ধারা বা শর্তসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো :

১. আইনসভা গঠন : এ চুক্তিতে বলা হয় বঙ্গীয় আইনসভায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে |

২. প্রতিনিধি নির্বাচন : এ চুক্তির ধারা অনুযায়ী বঙ্গীয় আইনসভায় ১৯০৯ সালের আইন প্রবর্তিত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ আইনসভার প্রতিনিধিত্ব নির্ধারিত হবে স্বতন্ত্র নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে |

৩. স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকবে ।

৪. চাকরিতে সমতা : সরকরি পদসমূহের শতকরা ৫৫ ভাগ পূরণ করবে মুসলমান সম্প্রদায় এবং যতদিন পর্যন্ত ঐ সংখ্যায় না পৌঁছাবে ততদি পর্যন্ত শতকরা ৮০ ভাগ সরকারি মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত থাকবে।

৫. সরকরি চাকরি : চাকরির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সমতা অর্জনের পর থেকে মুসলমান জনগণ চাকরির শতকরা ৪৫ ভাগ পাবে এবং অমুসলমানগণ শতকরা ৪৫ ভাগ পাবে এবং অন্তর্বর্তীকলীন সময় হিন্দু জনগণ ২০ ভাগ চাকরি পাবেন।

৬. ধর্মীয় অনুভূতি : ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে, এমন কোন আইন সংসদে পাস করা যাবে না। ধর্ম সংক্রান্ত আইন পাস করতে হলে আইনসভায় নির্বাচিত সদস্যদের সমর্থন থাকতে হবে।

৭. ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা : বলা হয় এ চুক্তিতে কোনো মসজিদ অতিক্রম করার সময় কোন শোভাযাত্রা সঙ্গীত বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ । কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মুসলমানদের গো-হত্যা নিষেধ করা যাবে না। তবে উন্মুক্ত স্থানে তা না করাই ভালো । এ চুক্তির প্রায় সবগুলো শত আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের অনুকূলে ছিল। চিত্তরঞ্জন দাস আইনসভায় বলেন, স্বরাজ্যের বুনিয়াদ রচনা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। স্বরাজ লাভের পর আমাদের সরকার না মুসলমান সরকারে না হিন্দু সরকার এরূপ কোন সংশয় মতে আমাদের মনে জাগ্রত না হয় সেজন্য আমরা এ চুক্তিতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করি ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বেঙ্গল প্যাক্টের মূল লক্ষ্যই ছিল রাজনৈতিক অবসান ঘটানো এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর দূর করে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তৈরি করা। চিত্তরঞ্জন দাস এর একান্ত ও নিরলস প্রচেষ্টায় যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে সম্প্রীতি গড়ে উঠে এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ তৈরি হয় এবং এর মধ্যে সকল নতুন আশার আলো তৈরি হয় ।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram