nulibrary

ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা ও প্রাচ্য সমস্যার আবর্তে অটোমান তুর্কিদের গৌরব অতীতের নামান্তরে পরিণত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৮ খ্রিঃ) তুর্কি সাম্রাজ্যের উপর এক মারাত্মক আঘাত হানে। যে অটোমান সাম্রাজ্য এক সময় সমস্ত ইউরোপের ভীতির কারণ ছিল তা এখন একেভারে ভেঙ্গে পড়ল। প্রেসিডেন্ট উইলসন ও লয়েড জর্জের আশ্বাস সত্ত্বেও মিত্রশক্তি অটোমান সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থা করল না; বরং সমগ্র তুরস্ককে গ্রাস করার আশঙ্কা দেখা দিল। দূরদর্শী কামাল সমসামরিক যুগের দর্পণে তুর্কি জাতীয়তাবোধকে প্রতিফলিত করে ইউরোপের রুগ্ন তুরস্ককে নব জীবন দান করেন।

→ কামাল আতাতুর্কের পরিচয় ও উত্থান : মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ছিলেন আধুনিক তুরস্কের জনক। কামাল আতাতুর্ক ম্যালোনিকার একটি কৃষক পরিবারে ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল ত্যাগ করে তিনি ম্যালোনিকার সামরিক একাডেমিতে যোগদান করেন। সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি উন্নতি লাভ করেন এবং তার মেধা ও কর্মদক্ষতার জন্য তাকে কনস্টান্টিনোপলের সামরিক একাডেমিতে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ সুলতান ছিলেন। কামাল আতাতুর্ক ওয়াতন নামে একটি গোপন সমিতি গঠন করেন, এর একটি শাখা দামেস্কে প্রতিষ্ঠা করেন। তার এ ‘ওয়াতন’ পরবর্তীতে Committed of union and progress এ রূপান্তরিত হয়। কামাল এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এ কমিটির সাহায্যে ১৯২২ সালে তুরস্কে সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে গড়ে ওঠে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। দেশপ্রেমিক মোস্তফা কামাল এ সাধারণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ।

→ কামাল পাশার সংস্কার : তুরস্কের পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে মুক্ত করে কামাল পাশা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটান। কামাল পাশা জার মহামতি পিটারের ন্যায় ইউরোপীয় পদ্ধতিতে তুরস্ককে পুনর্গঠন করতে চাইলেন। নতুন তুরস্কের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল হতে আঙ্কারায় স্থানান্তরিত হলো। তিনি তুরস্ককে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন সংস্কার সাধন করলেন ।

১. রাজনৈতিক সংস্কার : কামাল পাশা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার চালু করেন। সালতানাত ও খিলাফতের বিলোপ সাধন করে তিনি তুরস্কে সাধারণতন্ত্র কায়েম করেন এবং নিজে এর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কায়েম করেন। তাকে সাহায্য করার জন্য একটি মন্ত্রীসভা ছিল। ইসমত ইনানু ছিলেন এর মুখ্যমন্ত্রী এ মন্ত্রীসভা ছিল জাতীয় পরিষদের নিকট দায়ী। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রনীতির উপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র রচিত হলো। জাতীয় সভা সংস্কার ও বর্ধিত করা হলো। জাতীয় সভার সদস্য ছিল ৪৮৭ জন এবং এ সদস্যগণ ২২ বছর বয়স্ক লোকের ভোটে নির্বাচিত হলেন। জাতীয় সভায় সদস্যদের মধ্য হতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। তিনি পুননির্বাচিত হতে পারতেন। তিনি জাতীয় সভার পক্ষে কার্যকর ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের প্রধান ও সৈন্য বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। ক্যাবিনেট ছাড়াও অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অন্যান্য বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় পরিষদ ছিল। এটি উপদেষ্টা পরিষদের কাজ করত। তার সময়ে ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত সুযোগ সুবিধার বিলোপ সাধন করা হয়। আইনের নিকট সকলেই সমান ছিল এবং কাউকেও বিনাবিচারে আটক রাখা হতো না কামাল সরকারের নিকট জনসাধারণের জান, মাল, ধর্ম প্রভৃতি নিরাপদ ছিল। এককথায়, রাজনৈতিক দিক দিয়ে তুরস্ক আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

২. অর্থনৈতিক সংস্কার : দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপরই জাতীয় উন্নতি নির্ভর করে। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের করে ক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে প্রাচীন ক্যাপিচুলেশন প্রথা | বিলোপ করেন। এ প্রথার দ্বারা বিদেশীরা তুরস্কে সর্বপ্রকার হতো। সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারত। এছাড়া তিনি ঘৃণ্য মিল্লাত প্রথাও বিলুপ্ত করেন। মিল্লাত প্রথা তুরস্কের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি ছিল। এ প্রথানুযায়ী অমুসলমান প্রজাবর্গ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করত। অর্থনৈতিক বিপ্লবের পদক্ষেপ স্বরূপ কামাল আতাতুর্ক কৃষি, কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন। কৃষি প্রধান দেশ তুরস্কের উন্নতি ব্যবস্থা সাধনের জন্য কামাল আতাতুর্ক কৃষি বিপ্লব প্রবর্তন করেন। জমির উর্বরতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কামাল পানি সেচের সালে ব্যবস্থা করেন। কৃষি শিক্ষার প্রসারের জন্য আঙ্কারায় একটি কষি | ইস্তাম্বু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থা। করেন। মধ্য তুরস্কের ৩৫০০০ বর্গমাইল পতিত জমি চাষের | প্রশি উপযোগী করা হয়। এর ফলে দেশে পর্যাপ্ত শস্য উৎপাদন হয় । একি এবং অতিরিক্ত শস্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র কৃষকদের ঋণদানের ব্যবস্থা, কৃষি গবেষণা যাত দ্বারা উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ১৯৩৭ সালে তুরস্কে central বিে উন্ন Bank প্রতিষ্ঠা করা হয়। কামাল আতাতুর্কের প্রচেষ্টায় তুরস্কে শিল্পায়ন শুরু হয়। বিভিন্ন শহরে কলকারখানা স্থাপিত হয়। কামাল আতাতুর্কের প্রচেষ্টায় তুরস্কে শিল্পায়ন শুরু হয়। বিভিন্ন শহরে কলকারখানা স্থাপিত হয়। ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণে তুরস্কের শ্রীবৃদ্ধি হয়। এভাবে তিনি তুরস্কের সামরিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত করে তোলেন।

৩. সমাজ সংস্কার : কামাল পাশা সমাজ ব্যবস্থার এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেন। সামাজিক পরিবর্তনই হচ্ছে বিপ্লবের প্রকৃত ইঙ্গিত। মোস্তফা কামালের সামাজিক সংস্কারের ফলে তুরস্কের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি নতুন দেওয়ানি আইন সুইস বোর্ডের প্রবর্তন করেন। এসব আইন প সংহিতায় সকল নাগরিকের পূর্ণসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে নারী মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রধান বাধা চূড়ান্তরূপে দূরীভূত হয়। নতুন দেওয়ানি আইন মহিলাদের কাজের অধিকার শিক্ষার অধিকার, ধ তালাক দেবার অধিকার দান করে এবং পুরুষদের বহু বিবাহ প্রথা রহিত করে। চিকিৎসা ও আইনসহ সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ধর্মীয় সংস্কারের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং নতুন তেজশক্তির প্রতীক হিসাবে ফেজ, টুপি পরিধান ও অবলুণ্ঠন প্রথার বিলুপ্তি ঘটল। আর ইউরোপের হ্যাট পরিধান বাধ্যতামূলক করা হলো। এছাড়া ১৯৩৫ সালে শুক্রবারের পরিবর্তে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করল ।

৪. আইন সংস্কার : ১৯২৪ সালের ২০ এপ্রিল কামাল | আতাতুর্ক যথাক্রমে তিনটি আইন পাশ করেন। এর একটি ধারা ইসলামের বহু প্রাচীন খিলাফত বিলুপ্ত করেন। দ্বিতীয়টি ধারা ওয়াকফ বিধি ও জাতীয় বিভেদ বন্ধন ভঙ্গ করেন এবং তৃতীয়টি দ্বারা মাদ্রাসাগুলোর দায়িত্ব ইসলামের পরিবর্তে অন্যান্য শিক্ষা । প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা বিভাগের ওপর অর্পণ করেন।

৫. শিক্ষা সংস্কার : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এ সত্য উপলব্ধি করে কামাল পাশা শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। এতদিন পর্যন্ত তুর্কি বালকদেরকে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই দেয়া হতো। কামাল পাশার সরকার ধর্মীয় বিদ্যালয়ের বিলোপ সাধন করে অনেকগুলো ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন । এবং শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে দেন। তুর্কি ভাষার পাশাপাশি আরবি পাঠ অবশ্য করণীয় ছিল। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে কোন প্রভেদ ছিল না। প্রতি বছর উচ্চতর শিক্ষার জন্য সরকার বৃত্তি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কর্মক্ষম ও মেধাবী ছাত্রদের নির্বাচিত করেন এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠাতেন। তিনি ১৯৩৫ সালে আঙ্কারাতে একটি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুল বিশ্ব বিদ্যালয় দুটি উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। তুরস্কের আইন অনুসারে প্রত্যেক যুবকের তিন বছর সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল। এটি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার একটি অন্যতম অঙ্গ ছিল ।

৬. যাতায়াত ব্যবস্থার সংস্কার : মোস্তাফা কামাল পাশা যাতায়াতের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন করে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি সাধন করেন। রেলপথ স্থাপন ও বিস্তার ছিল এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সামরিক ও বাণিজ্যিক রেলপথসমূহ প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের জন্য ছিল কল্যাণকর। আনথেবেসিক নামক ৮০ মাইল পর্যন্ত রেলপথটি ৩০ লক্ষ তুরস্ক পাউন্ড ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। এছাড়া তিনি পুরাতন রাস্তাঘাট মেরামত করেন।

৭. শিল্প ব্যবস্থা : তুরস্কের শিল্পায়ন শুরু হয় কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে। তিনি বিভিন্ন শহরে শিল্প কারখানা স্থাপন করেন। বাশাবাকাশাতে কাচের, কায় সায়িওতে কাপড়ের, আমামিতে কাগজের, বাসেলিয়াতে তুলার, বারজারেটে পশমের কারখানা স্থাপিত হয়। এছাড়া খনিজ পদার্থ আবিষ্কারের মাধ্যমে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তুরস্কের শ্রীবৃদ্ধি পায় । আর তুরস্কে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়।

৮. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : তুরস্ককে রক্ষা করার জন্য কামাল পাশা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী করেন। ফলে উন্নত ধরনের সামরিক শিক্ষা দ্বারা তুর্কি স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী গঠিত হয়। তিনি নৌবাহিনীর আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় নতুন সমরপোত নির্মিত হয়। এছাড়া নতুন নতুন জাহাজও নির্মিত হয়। ফলে তুর্কি বাহিনী বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর মর্যাদা লাভ করে।

৯. ল্যাটিন বর্ণমালার ব্যবহার : ১৯২৮ সালে তুরস্কে আরবি বর্ণমালার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে তিনি ল্যাটিন বর্ণমালাকে সরকারি বর্ণমালা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে এক আইনের বলে বাইজান্টাইন কনস্টান্টিনোপলের বদলে তুর্কি ইস্তাম্বুল, গ্রিক আদ্রিয়ানোপলের পরিবর্তে ইউরিন, স্বর্ণার বদলে ইজমির এবং মারো নাম নতুন আকারে রূপান্তরিত হয়। ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে কামাল আতাতুর্ক তুর্কি ভাষা সংক্রান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও ১৯৩৫ সালের এক বিজ্ঞপ্তিতে তুর্কিদেরকে ইউরোপীয় উপনাম গ্রহণ করার অনুমোদন দেয়া হয়।

→ তুরস্কের জনক হিসেবে কামাল পাশা : কামাল তুরস্ককে সাম্রাজ্যবাদী করাল গ্রাস এবং নিজ দেশীয় শাসকদের অত্যাচার এ হতে শুধু উদ্ধারই করেননি বরং যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও বিদেশি শোষণে পর্যদুস্ত তুরস্ককে একটি শক্তিশালী আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তুরস্কের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনয়ন নি করেন। তার সংস্কারের ব্যাপকতা সবদিকে ছিল। কোন দিক এবং কোনো বিভাগই তার সূক্ষ্ম দৃষ্টির বহির্ভূত ছিল না। তার অ গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বের কথা বিবেচনা করেই তাকে তুরস্কের প্র পিতা (Father of Tourkey) উপাধিতে ভূষিত করা হয় ৷

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, কামাল আতাতুর্ক তার জ বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্ককে একটি আধুনিক ইউরোপীয় ও রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ‘তার মূল মন্ত্র ছিল তুর্কি হও, মুসলমান হও এবং আধুনিক হও'। নারী স্বাধীনতা তাকে প্রাচ্য নৃপতিদের মধ্যে জ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। তবে ঐতিহাসিকরা তার প্রতি বিরূপ মন্তব্য হ করেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তুর্কি জনগোষ্ঠী তাকে স্বীকার করে বি · নিয়েছে আতাতুর্ক হিসেবে। তাই নিরপেক্ষভাবে যদি কামালকে বিচার করতে হয়, তাহলে তার দেশবাসীর মন্তব্যই প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ দেশবাসী তার যথার্থ বিচারক। মোস্তফা কামাল তার ব দেশকে ভালোবেসেছিল, ভালোবেসেছিলেন তার জাতিকে ।

ভূমিকা : বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে যে কয়টি অঞ্চল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তন্মধ্যে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল অন্যতম । সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার পত্তন হয়েছিল। তাছাড়া বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশের উত্থান ঘটে এই পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে। এদের মধ্যে রোমান, বাইজান্টাইন, সেলজুক ও অটোমান সালতানাত উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমুদ্র, যেমন- কাজিয়ান, ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ লোহিত সাগরের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে এই অঞ্চলে বিশাল তেল গ্যাসের মজুত প্রাপ্তির ফলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্ব পরাশক্তিরা পর্যায়ক্রমে এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নিম্নে প্রশ্নালোকে পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. ভৌগোলিক অবস্থান : সাধারণভাবে পশ্চিম এশিয়া বলতে এশিয়া মহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলকেই বুঝানো হয়ে থাকে। ভৌগোলিকভাবে এটি ইউরোপ মহাদেশের পূর্বে অবস্থিত। পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপকে বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিকরা সংক্ষেপে ইউরোপিয়া বলেও আখ্যায়িত করে থাকে। পশ্চিম এশিয়ার উত্তর দিকে ককেশাস পর্বতমালা দ্বারা এটি ইউরোপ মহাদেশে থেকে পৃথক হয়েছে এবং বসফরাস প্রণালি দ্বারা এটি আফ্রিকা মহাদেশে থেকে পৃথক হয়েছে। পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে মোট ২১টি রাষ্ট্র রয়েছে।

২. আরব ও অনারব অঞ্চল : পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব পর্যালোচনার আগে এর আরব অনারব অঞ্চল সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার ।
(ক) আরব দেশসমূহ : এই অঞ্চলের আরব দেশসমূহ হলো সৌদি আরব, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্জিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, ওমান ও লেবানন। এই দেশগুলোর ধর্ম প্রধানত ইসলাম এবং ভাষা আরবি এরা মূলত উমাইয়া ও অটোমান সালতানাত দ্বারা শাসিত ছিল। এই অঞ্চলে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং শিয়া সুন্নি বিরোধও মারাত্মক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলের দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে।
(খ) অনারব দেশসমূহ : পশ্চিম এশিয়ায় উপরিউক্ত আরব দেশগুলোর পাশাপাশি কয়েকটি অনারব দেশও আছে। - আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইরান ও তুরস্ক। এই অঞ্চলগুলো মুসলিম অধ্যুষিত এবং সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে ইরানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অঞ্চলের ভাষাও আরবি নয়, বরং প্রতিটি দেশের আলাদা ভাষা ও কৃষ্টি সংস্কৃতি আছে।

৩. ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব : ভৌগোলিকভাবে পশ্চিম এশিয়া এশিয়া অঞ্চলটি এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ১৮৫৯ সালে মিশরে সুয়েজ খাল খননের ফলে এই অঞ্চলের সাথে আফ্রিকার সরাসরি বাণিজ্য পথ তৈরি হয়। সুয়েজ খালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সাথে লোহিত সাগরের একটা সংযোগ সাধিত হয়েছে। ফলে বাণিজ্যিকভাবে এশিয়া ও ইউরোপের সাথে আফ্রিকা মহাদেশের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্ব বাড়তে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে ব্রিটিশ নৌবহর কয়লার পরিবর্তে তেল উ ব্যবহার শুরু করলে তেলের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রথম ও বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই অঞ্চলটি অক্ষ শক্তি ও মিত্রশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মিত্রবাহিনী এ সময় আফ্রিকা থেকে ইরান পর্যন্ত এই বিশাল অঞ্চলে যুদ্ধরত ছিল এবং সামরিক প্রয়োজনে এই পুরো অঞ্চলটিকে মিত্রবাহিনী এক সামরিক প্রয়োজন এই পুরো অঞ্চলটিকে মিত্রবাহিনী এক সামরিক ইউনিটের আওতায় পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য বলে অভিহিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তির সাথে সথে অটোমানদের পরাজয়ের ফলে এই এলাকাটি মিত্র শক্তির অধীনে চলে যায় এবং তুরস্কের ক্ষুদ্র আয়তন ছাড়া বেশির ভাগ অঞ্চলকে হয় স্বাধীনতাদান বা ম্যান্ডেটরি শাসনের অধীনে আনা হয়। ১৯৩০ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে তেলের বিশাল মজুতের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে এই অঞ্চলের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নেতৃত্বাধীন অক্ষ শক্তি পরাজিত হলে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব মিত্র শক্তির হাতে চলে যায়। এই অঞ্চলে এতদিন ব্রিটিশ প্রভাবাধীন থাকায় তারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হয় এবং এই অঞ্চলের বিশাল তেলের মজুত নিজেদের হস্তগত করার আশায় বিভিন্ন সামরিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে। এ সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রিটেনের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ফ্রান্স ও তেলের চাহিদাপূরণের এই অঞ্চলের দিকে মনোনিবেশ স্থাপন করেন। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় তারাও এই অঞ্চলের প্রভাব বিস্তার ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পাশাপাশি এ সময় ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নিজেদের ক্রমবর্ধমান তেলের চাহিদা মেটানোর জন্য এবং সমাজতান্ত্রিক বলয় প্রতিরোধের জন্য পশ্চিম এশিয়ায়, সামরিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে বিশ্ব পরাশক্তিসমূহের পশ্চিম এশিয়াকেন্দ্রিক এই প্রচেষ্টা অধ্যবদি চলমান আছে। অবশ্য বর্তমানে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক অটোমান সালতানাতের গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট আছে এবং এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন শক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করছে। যা এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক টানাফেডিন আরো বৃদ্ধি করবে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পশ্চিম এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিশাল খনিজ তেল গ্যাসের ভাণ্ডার বিশ্ব রাজনীতিতে তার আলাদা গুরুত্ব তৈরি করেছে। কারণ বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা চলছে তেল নির্ভর হয়ে। তেল ছাড়া বর্তমান বিশ্বসভ্যতা অচল। তাই তেলের এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিশ্ব পরাশক্তিসমূহ পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। তাছাড়া কাস্পিয়ান সাগর, কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের ফলে এশিয়া ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যেও এই অঞ্চলের গুরুত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই চলছে।

ভূমিকা : উনিশ শতকে অটোমান শাসনের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নজদকে কেন্দ্র করে আরব অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে সৌদি রাজবংশ। বিশ শতকের শুরুতে বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের ফলে আরব অঞ্চলে সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। সৌদি রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পিছনে ওয়াহাবী মতবাদ ও | ইখওয়ান বাহিনীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াহাবী মতবাদ প্রচার এবং সে আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য সে সময় একটি বিশেষ বাহিনী প্রয়োজন ছিল। আর সেটি হলো ইখওয়ান বাহিনী । নিম্নে প্রশ্নালোকে আলোচনা করা হলো-

→ ইখওয়ান বাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপট : মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব কর্তৃক প্রবর্তিত ওয়াহাবি মতবাদ প্রাথমিককালে নেজদ অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে এ আন্দোলন সমগ্র আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াহাবি মতবাদের রক্ষক সউদী রাজবংশ যখন তাদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে তখন তারা বাধা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয় এবং সেজন্যই ইখওয়ান বাহিনী গঠিত হয়।
ইখওয়ান বাহিনী প্রতিষ্ঠা : ১৯০২-১৯১২ পর্যন্ত আব্দুল আজিজ ইবনে সউদের পরিবার ও মক্কার শরীফ হোসাইন এবং তুর্কি সুলতানের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিরোধিতার নিরসনে তিনি আল ইখওয়ান বা ব্রাদারহুট নামে একটি বাহিনী গঠন করেন। যেটি ইখওয়ান নামে পরিচিত।

কাজ : ইখওয়ান সৃষ্টির মাধ্যমে শুধু দুর্ধর্ষ আরব বেদুইন গোত্রের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণেই সমর্থ হননি, বরং আরব বেদুইনদের একতাবদ্ধ করে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান ইবনে সউদ। যা পরবর্তী সত্যিকার অর্থে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কাজ করতে সমর্থ হয়েছিল এবং সৌদি রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ভূমিকা রাখতে পেরেছিল।
মতবাদ ও আদর্শ : এই বাহিনীর মূলত ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসী ছিল এবং ওয়াহাবী মতবাদের আদর্শে উজ্জীবিত ছিল । আরব উপজাতীয়দের বিরোধিতা বন্ধ করে সকল বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জাতীয় চেতনাবোধ সৃষ্টিই ছিল এই বাহিনী সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য।

সংগঠন : ইখওয়ান বাহিনীর সদস্যরা সামরিক ছাউনি বা হিজাবে বসবাস করতো। ইবনে সউদ এরকম ২০০টির অধিক হিজবা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে প্রায় ১০,০০০ সৈন্য ছিল। এ বাহিনীর সহায়তার ইবনে সউদ নজদ, হাসা, কাতিফ, জুবাইলসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সৌদি রাজবংশ প্রতিষ্ঠায় যে কয়টি সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এর মধ্যে অন্যতম ছিল ইখওয়ান। ইখওয়ানরা ছিল মূলত ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসী। ওয়াহাবী আন্দোলনের কর্মীদের একটি সশস্ত্র ইউনিট ছিল ইখওয়ান । ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসী হিসেবে ইবনে ইখওয়ানকে ব্যবহার করেন সৌদি আরব তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং বলা যায় যে, সৌদির রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পিছনে ইখওয়ানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

ভূমিকা : মিশরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে সাদ জগলুল পাশার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। জাতির মহাদুর্দিনে আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন এক নতুন রাজনৈতিক ব্যক্তি জগলুল পাশা। তিনি ১৯১৯ সালের প্রথম দিকে ওয়াফাদ পার্টির নামে একটি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ভূমিকা পালন করে। তার এ ওয়াফদ পার্টি মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ।

→ ওয়াফদ পার্টি : সাদ জগলুল পাশা ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য উপলব্ধি করেন যে, যদি তার নেতৃত্বে জন সমর্থন লাভ করে কোনো প্রতিনিধি দল পরিচালিত করতে হয় তাহলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ স্বীকৃত একটি অফিসিয়াল ন ডেলিগেশন গঠন বাঞ্চনীয়। তিনি বুঝতে পারেন যে, অফিসিয়াল ডেলিগেশন গঠনের ফলে সরকার বা সুলতানের তরফ থেকে অন্য কোনো প্রতিনিধি দল প্রেরণের সম্ভাবনা থাকবে না । উপরন্তু সর্বজন সমর্থিত অফিসিয়াল ডেলিগেশনের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার আলাপ-আলোচনায় বসতে রাজী হবে। অতঃপর ১৯১৮ সালের ১৩ নভেম্বর ওয়াফদ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। স্থায়ী প্রতিনিধি দলটি আল ওয়াফদ আল মিশর নামে পরিচিত। অথবা, মিশরীয় ডেলিগেশন নামে পরিচিত।
ওয়াফদ পার্টির সংবিধান : এই প্রতিনিধি সভার পূর্ববর্তী আইন সভার দু'একজন সদস্য ব্যতীত প্রায় সকলেই সভ্য ছিল । এ ওয়াফদ পার্টির সংবিধানে দুটি অনুচ্ছেদ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিন। যথা :

১. এই দলের প্রধান লক্ষ্য হলো ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আইনসঙ্গত এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিশরের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন।
২. এই দলের প্রধান শক্তি হচ্ছে জনসমর্থন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দরখাস্ত স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ৩ ধরনের কার্যব্যবস্থা বন্ধের জন্য মন্ত্রণালয়কে চাপ দেয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সাদ জগলুল পাশার অবদান অনস্বীকার্য। তার প্রতিষ্ঠিত ওয়াফদ পার্টি মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল না হলেও গণপ্রতিনিধিত্ব দ্বারা ওয়াফদ পার্টি সৃষ্টি মিশরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত।

ভূমিকা : উনিশ শতকেই সৌদি আরব ভূখণ্ডে সৌদি আরব নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় সৌদি রাজ পরিবার। আধুনিক তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব রাষ্ট্রের অভ্যুত্থানের গোড়াপত্তন হয় ওয়াহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে। মূলত ওয়াহাবি একটি ধর্মীয় সংস্কারবাদী মতবাদ। নানা ধরনের কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পর্যবসিত ইসলামকে তার পূর্বের অবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মানসে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মূলত এ মতবাদের আলোকেই আরবীয়রা একত্রিত হয় এবং সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ।

→ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব : ওয়াহাবী মতবাদের মূল প্রবক্তা হলেন ইবনে আব্দুল ওয়াহাব। তিনি মধ্য আরবের নজদ অঞ্চলে উখাইন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনকাল ১৭০৩ থেকে ১৭৯২ সাল। তিনি ছিলেন একজন ধর্ম সংস্কারক। তিনি বনী তামীম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন । পড়াশোনা করেন ধর্মতত্ত্ব ও আইনতত্ত্ব বিষয়ে বাগদাদ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। তিনি হেজাজ ইরাক, সিরিয়া সহ সমগ্র আরবে ভ্রমণ করেন এবং মুসলমানদের কুসংস্কারছোন্ন অনৈতিক কাজ দেখে ব্যথিত হন ।

→ আব্দুল ওহাবের মতবাদ : আব্দুল ওয়াহাব ছিলেন ধর্মভীরু, গোড়াপন্থি এবং অনমনীয় মনোভাবের ব্যক্তি। ধর্মীয় সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ইসলামের পবিত্রতা ও প্রকৃত মূল্যবোধ রক্ষার্থে সকল প্রকার কুসংস্কারের তিনি জিহাদ ঘোষণা করেন। নিম্নে ওয়াহাবী মতবাদসমূহ আলোচনা করা হলো-

১. মতবাদ প্রচার : আব্দুল ওহাব সমগ্র আরব ভূখণ্ড ঘুরে স্বদেশে অর্থাৎ নজদ অঞ্চলে এসে ইসলামের শুদ্ধির জন্য মতবাদ প্রচার শুরু করেন। তার মতবাদ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত মুসলমানদের পুনরুজ্জীবিত করে। তার এই ধর্মীয় পুনর্জীবন আন্দোলন মুহাম্মদী আন্দোলন বা ওয়াহাবী আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। ওয়াহাবী মতবাদের বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল তৌহিদ

২. ওয়াহাবী মতবাদ ও সৌদি রাজবংশ : ওয়াহাবী মতবাদ সৌদি রাজবংশ তাদের ধর্মীয় মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকে। সৌদি বংশের পৃষ্ঠপোষকতার ওয়াহাবি মতবাদ বেশ সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। ইবনে সৌদি এ মতবাদে বিশ্বাসী এবং এই মতবাদ প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নজদকে কেন্দ্র করে আরব অঞ্চলে যে প্রতিপত্তিশালী সৌদি রাজবংশের উত্থান হয় তার পিছনে একটি বড় নিয়ামক শক্তি ছিল ওয়াহাবী আন্দোলন। ওয়াহাবী মতবাদ এ সময় আরব অঞ্চলের মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। আরব জাতি এ মতবাদের মাধ্যমে একত্রিত হয়। সৌদি আরবের ইতিহাসে ওয়াহাবী মতবাদ তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বের ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থা একটি আলোচিত ও সমালোচিত শাসনব্যবস্থা। মিত্র শক্তিবর্গ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে পরাজিত অক্ষ শক্তির দেশগুলোর সম্পদবহুল বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা চালায় তারই পরিমার্জিত করা ছিল ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থা। ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত লীগ অব নেশনসের তত্ত্বাবধানে উপনেবেশিক শাসনব্যবস্থার আধুনিক রূপ। নিম্নে প্রশ্নালোকে ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থার পরিচয় দেওয়া হলো :

আভিধানিক অর্থ : ইংরেজি Mandate শব্দের বাংলা পরিভাষা দাঁড়ায় কার্যভার অর্পণ বা আদেশ দান। অন্য কথায় এটাকে শাসনের অনুমোদনও বলা যেতে পারে। ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থা নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রযুক্ত হয় ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা ম্যান্ডেটরি শাসন কাঠামো বিষয়ে Encyclopedia-তে বলা হয়েছে যে, ““The mandate system was a compronise between the Allies wish to retain the former germen and Turkish colonies and mandate an authorization granted by the league of nations to a member nation to govern a former German or Turkish colony. The terettory was called a mandated teritory or mandate."

ড. নজরুল ইসলামের মতে, “জাতিপুঞ্জ বা অনরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো রাষ্ট্রকে প্রদত্ত ভিন্ন দেখা শাসনের অধিকারই হলো ম্যান্ডেট।”.
জী ব্যবহারিক অর্থে : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও অটোমান সালতানাত অক্ষ শক্তি হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ফ্রান্স ইতালিসহ অন্যান্যদের মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়। ফলে জার্মানি ও অটোমান সালতানাতের অঞ্চলগুলোতে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়। তাই বিজয়ী মিত্র শক্তি প্যারিস সম্মেলনে জার্মানি ও অটোমান সালতানাতের সম্পদশালী অঞ্চলগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এ সময় মিত্র শক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে সেই চেষ্টা বিলম্বিত হয়। তাই লীগ অব নেশনস গঠিত হওয়ার পর এর মধ্যস্থতায় ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ম্যান্ডেটগুলো দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল । যথা-

(ক) মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ায় ম্যান্ডেট এখানে ফ্রান্স ও ব্রিটেন ম্যান্ডেটরি শাসন কায়েম করে ।
(খ) আফ্রিকান ম্যান্ডেট এখানকার সিরিয়া ও লেবাননের ম্যান্ডেট লাভ করে ফ্রান্স আর প্যালেস্টাইন, ট্রান্সজর্ডান মেসোপটেমীয়ার ম্যান্ডেট লাভ করে গ্রেট ব্রিটেন

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত ঔপনেবিশিক শাসন কাঠামোরই আধুনিকতম রূপ । এর মাধ্যমে জার্মান রাষ্ট্র ও অটোমান সালতানাতের বিভিন্ন সম্পদশালী অঞ্চলগুলো ফ্রান্স ব্রিটেন নিজেদের মধ্যে লীগ অব নেশাসনের সহায়তায় ভাগ বাটোয়ারা করে দেন।

ভূমিকা : সিরিয়া ফ্রান্স কর্তৃক অধিকৃত হয় ১৯২০ সালে। তুর্কি ওসমানীয় সাম্রাজ্যে সিরিয়া বলতে প্যালেস্টাইন ও লেবাননকে বুঝাত। এই দুই রাষ্ট্রকে একসাথে Levant বলা হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে আরব জনগণ বিশেষ করে আরবের ফারটাইল ক্রিসেন্টের জনগণের তুর্কি বিরোধী মনোভাব, দামেস্কাস প্রটোকল, পিকো-ম্যাকমোহন সমঝোতা প্রভৃতি ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ১৯২০ সালে ফ্রান্স সিরিয়া দখল করে নেয়।

→ হোসেন ম্যাকমোহন পত্রালাপ : ১৯১৫ সালের ১৪ জুলাই হতে ১৯১৬ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত আরবদের পক্ষে শরীফ হোসেন ও গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষে স্যার হেনরি ম্যাকমোহন যে দশটি পত্র বিনিময় করেন সেগুলো ইতিহাসে হোসেন ম্যাকমোহন পত্রালাপ বা "Hussain Mc mahon Correspondence" নামে পরিচিত। এ পত্রালাপে দুইটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তা হলো-
(ক) ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে সৈন্য সংগ্রহ করে যুদ্ধ করবে বলে শরীফ হোসেন ওয়াদা করেন এবং গ্রেট ব্রিটেন জয়ী হলে আরবদের স্বাধীনতা দিবেন বলে স্যার হেনরি ম্যাকমোহন অঙ্গীকার করেন ।
(খ) স্বাধীন আরব জাতির সীমানা নিয়েও আলোচনা করা হয় পত্রালাপগুলোতে। গ্রেট ব্রিটেন যুদ্ধে তার মিত্র শক্তি ফ্রান্সের স্বার্থের কথা চিন্তায় রেখে আরব জাতীয় সীমানা ছোট করে দেন। ম্যাকমোহন বলেন- দামেস্ক, হোমস, হ্যামাও, আলেপ্পো জেলার পশ্চিমে সিরিয়ার অংশগুলোকে সম্পূর্ণরূপে আরব বলা যায় না। তাই এ অঞ্চলগুলো স্বাধীন আরবজাতীয় সীমানার বাইরে থাকবে।এ সম্পর্কে শরীফ হোসেন বলেন, তিনি এ সীমানানীতি সাময়িকভাবে মেনে নিয়েছেন। যুদ্ধের পর এটা নিয়ে ফ্রান্সের সাথে চূড়ান্ত বুঝাপড়া করে সীমানা নির্ধারণ করবেন।

চুক্তির অস্বীকার : হোসেন ম্যাকমোহন পত্রালাপ বন্ধের পর নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সাইকস পিকো চুক্তি স্বাক্ষর করে স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের জন্য দেয়া প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করে। এদিকে আরবরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ঘটনাক্রমে ১৯১৮ সালের ২৯ অক্টোবর তুর্কিগণ মারজেদাবিকের যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।

উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, ফরাসি বাহিনী সিরিয়া দখল করলে ফয়সালের নেতত্বে প্রতিষ্ঠিত আরব সরকারের পতন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে ব্রিটেন ও ফ্রান্স গোপন চুক্তির মাধ্যমে ফারটাইল ক্রিসেন্টকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং ১৯২০ সালে সিরিয়া দখল করে নেয় ফ্রান্স ।

ভূমিকা : ১২৮৮ সালে ওসমানীয় সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর্যায়ক্রমে আরব ভূখণ্ডসমূহ ওসমানীয় সালতানাতের অধীনে চলে আসে। কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে দুর্বল ওসমানীয় সুলতানদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধে আরব জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চার হয়। এ সময় কিছু খ্রিস্টান মিশনারীদের সাহায্যে গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়ে তারা আরব জাতীয়তাবাদের প্রসাবে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে। নাসিফ ইয়াজিজী আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশের অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

নাসিফ ইয়াজিজীর পরিচয় : নাসিফ ইয়াজিজী ১৮৮০ সালে বর্তমান লেবাননের একটি ক্ষুদ্র গ্রামের খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অতি বাল্যকাল থেকেই ইয়াজিজীর ছিল প্রচণ্ড জ্ঞান স্পৃহা। ফলে পরিবারের সীমিত জ্ঞান সাধনা তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারেনি। তাই জ্ঞানার্জনের তাড়নায় তিনি গীর্জার লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বই ও পাণ্ডুলিপি অধ্যায় শুরু করেন। তার জ্ঞানার্জনের স্পৃহা দেখে গির্জার পুরোহিত তাকে বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দান করেন। ফলে অল্প বয়সেই তিনি প্রচুর বই অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। প্রচণ্ড মেধা ও স্মৃতি শক্তির অধিকারী হওয়ায় তিনি প্রভূত জ্ঞানার্জনে সক্ষম হন। এ সময় নাসিফ আরবি সাহিত্য অধ্যায়নে বিশেষ মনোযোগী হয়ে ন উঠেন। আরবি ভাষায় বিশাল সাহিত্য ভান্ডার তাকে মুগ্ধ করে তোলে। তখন তিনি আরবি ভাষার পুনর্জাগরণের আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি আরবি ভাষায় ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা অলংকার শাস্ত্র বিষয়ে প্রস্তুত রচনা শুরু করেন। তার এসব লেখা সাহিত্যের ছাত্র শিক্ষক সবার কাছেই সমানভাবে সমাদৃত হয়। পুস্তক রচনার পাশাপাশি কর্মজীবনের অবসর সময়ে তিনি তার বাসায় আরবি ভাষায় সাহিত্য চর্চার আলোচনার আসর বসাতেন। এ সময় আরব জনগণ নিজ মাতৃভাষা ও সাহিত্য জানার জন্য দলে দলে এই সাহিত্য আসবে জমায়েত হতে থাকে। আর এসকল সাহিত্য আলোচনা চক্রের মাধ্যমে আরব জনগণ বিশাল আরবি সাহিত্যের ভাণ্ডার সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এসব সাহিত্য সভায় নাসিফ জনগণকে মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বারোপের উপদেশ দিতেন। ফলে ধীরে ধীরে আরব জনপদগুলোতে নাসিফ খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।জনগণ তুর্কি ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পরিবর্তে আরবি ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী হয়ে ওঠে । এভাবে র ধীরে ধীরে আরব জনগণের মাঝে তুর্কি শাসনের বিরোধিতা ও । আরব জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ লাভ করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, লেবাননের এক ক্ষুদ্র গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নাসিফ ইয়াজিজী তার জ্ঞান প্রজ্ঞা ও | কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তায় পরিণত হন। । তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে আরব অঞ্চলের জনগণের মধ্যে আরবি ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। ফলে জনগণ | ধীরে ধীরে আরব জাতীয়তাবাদী চিন্তায় মননে আকৃষ্ট হয়ে উঠে।

ভূমিকা : মিশারসহ মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে মুসলিম ব্রাদারহুড একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে তাদের শক্তিশালী সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জন করে। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম উম্মাহর অন্যান্য দেশে ও মুসলিম ব্রাদারহুডের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। মুসলিম মুসলিম ব্রাদারহুড একটি রক্ষণশীল ইসলামি রাজনৈতিক দল যারা রাষ্ট্রপরিচালনায় আল কুরআনের বিধান বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিম্নে প্রশ্নালোকে মুসলিম ব্রাহারহুডের পরিচয় আলোচনা করা হলো :

মুসলিম ব্রাদারহুড : বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ দল হলো মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরে প্রতিষ্ঠিত এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্কুল শিক্ষক ইমাম হাসান আল বান্না যাকে বর্তমানে মুর্শিদ-আল-আম বলা হয়। মুসলিম ব্রাদারহুড সৌদি আরবের আব্দুল ওয়াহাবের ওয়াহাবী আন্দোলন ও জামাল উদ্দিন | আফগানীর আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ইমাম হাসান আল বান্না মিশরের ইসমাইলিয়া শহরে প্রথম এই | দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার নীতি আদর্শ জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য কায়রো ও ইসমাইলিয়ার বিভিন্ন কফিশপে উন্মুক্ত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। তার সুসমন্বিত প্রচারণার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিন দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পরবর্তীতে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলিম ব্রাদারহুড তার উদ্দেশ্য ও আদর্শ আরো বিস্তৃত পরিসরে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন সান্ধ্য স্কুল, ইসলামের উপর উন্মুক্ত বক্তৃতা, বিভিন্ন জনহিতকর কাজ দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মহিলাদের স্বার্থরক্ষায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করে। তাছাড়া সংগঠন থেকে গরিব ও অসহায় জনগণের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহেরও ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিশরে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম ব্রাদারহুড ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এমনকি মিশরের প্রতি ৩ জনের ২ জনই এ সময় ব্রাদারহুড় সমর্থক হয়ে যায়, রাজনীতিতে তারা সরকারের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলে ১৯৪৮ সালে ইমাম হাসান আল বান্নাকে নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরবর্তী প্রধান সাইয়েদ কুতুবসহ প্রচুর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ গুপ্তহত্যা ও বিচারিক হত্যার শিকার হন। সর্বশেষ দলটি মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ১ বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর ক্যুর ফলে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং প্রধানমন্ত্রী মুরসিসহ বহু শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিচারাধীন অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেন ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল, দাতব্য সামাজিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে খুব দ্রুত তারা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সরকারের ব্যাপক দমনপীড়নের ফলে বিভিন্ন সময় এই দলের বহু শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গুপ্তহত্যা ও বিচারিক হত্যার শিকার হয়েছেন।

ভূমিকা : ১২৮৮ সালে আরতুগরল গাজীর ছেলে ওসমান কর্তৃক কুনিয়ায় ওসমানীয় সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর সময়ের স্রোতে তা তিন মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত হয়। এ সময় পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের আরব ভূখণ্ডগুলো ও ওসমানীয় সালতানাতের শাসনাধীনে আসে। কিন্তু ৩০ শতাব্দীতে ওসমানীয় সুলতানদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দমন পীড়নের জন্য আরব ভূখণ্ডগুলোতে স্বাধীনতা চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এই চেতনার বিরুদ্ধে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে আরব জাতীয়তাবাদী চেতনা ।
আরব জাতীয়তাবাদ : পশ্চিম এশিয়া ভূখণ্ডের আরব গোত্রগুলো দীর্ঘদিন ওসমানীয় খিলাফতের শাসনাধীন ছিল। ফলে তুর্কি ভাষা সংস্কৃতি ইত্যাদি এই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। আরব জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রকাশ ঘটে সৌদি আরবের নজদে মুহাম্মদ আল ওয়াহাবের মাধ্যমে। তিনি ইসলামের সকল কুসংস্কার, পির মাজার ইত্যাদি বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তাছাড়া তিনি নজদের শক্তিশালী সউদ বংশের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আরব স্বাতন্ত্র্য ও আরব শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ১৮৭৫ সালের জুন মাসে লেবাননে খ্রিস্টান মিশনারী সংঘের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে গুপ্ত সমিতি তারা আরবি ভাষা সংস্কৃতি বিকাশে ব্যাপক প্রচারণা পোস্টারিং করে জনসাধারণকে আরব জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে তারা লেবাননসহ সিরিয়ার স্বাধীনতা দাবি করে তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশের এক প্রবাদ প্রতীম পুরুষ ছিলেন নাসিফ ইয়াজিজী। তিনি লেবাননের এক ক্ষুদ্র গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্মলাভ করেন। পরে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানার্জন শেষে তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। তিনি আরবি ভাষায় বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার নিয়ে জনগণের সাথে আলোচনা চক্র অনুষ্ঠান শুরু করেন এবং জনগণকে আরবি ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন। এ সময় সারা বিশ্বেই গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, ও মানবাধিকার আদর্শের প্রসার ঘটতে থাকে। ফলে আরব বংশগুলোও পাশ্চাত্যের প্রভাবে জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠেন। তাই বলা যায় আরব জাতীয়তাবাদ একটা সামগ্রিক চিন্তা যা স্বাতন্ত্র্য রাষ্ট্র গঠনের বাস্তব রূপ, এ সময় মোহাম্মদ আলী পাশা মিশরে তুর্কি ও ব্রিটিশদের পরাস্ত করেন। সিরিয়ায় জনগণ ও প্রকাশ্যে তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধাচারণ করে। সৌদি আরবে ইবনে সৌদের নেতৃত্বে আরব শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, অটোমান সুলতানরা তাদের দীর্ঘ শাসনামলে তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতি সম্প্রসারিত করতে গিয়ে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন করেন। | তাছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে দুর্বল অটোমান সুলতানদের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতি আরব জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে | বিভিন্ন আরব অঞ্চলে আরব জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ও স্বাধীন্তার আন্দোলন শুরু হয়।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram