nulibrary

ভূমিকা : ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা জাতীয়দের দাবিদাওয়ার একটা বিশেষ দিক বাস্তবায়নের অগ্রগতি সাধন হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ধারায় ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে ।

→ ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ভারতীয়দের নানা দাবিদাওয়ার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৮৯২ সালে ভারত কাউন্সিল আইন প্রবর্তিত হয়। এ আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো :

১. ১৮৯২ সালের আইনে আইন পরিষদগুলোতে সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নীতি গৃহীত হয়।

২. ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে কমপক্ষে ১০ জন আর সর্বোচ্চ ১৬ জন সদস্য অন্তর্ভুক্তি করার ব্যবস্থা গৃহীত হয় ৷

৩. এ আইনে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোতে বেসরকারি সদস্যরা কতিপয় স্থানীয় সংস্থা যেমন- বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট, জেলা বোর্ড, লোকাল বোর্ড প্রভৃতির সুপারিশক্রমে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হবে বলে স্থির করা হয় ।

৪. এ আইনের মাধ্যমে জনস্বার্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে পরিষদগুলোকে শাসন বিভাগকে কিছু প্রশ্ন করার অধিকার লাভ করে ।

৫. ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের বেসরকারি সদস্যরা ‘বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স'-এর সুপারিশক্রমে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হবে বলে স্থির হয় ।

তাছাড়া ১৮৯২ সালের আইনে আইন পরিষদগুলো সরকারি আয়-ব্যয় সম্পর্কিত হিসাব নিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা করার অধিকার লাভ করে ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের দ্বারা ভারতীয়রা যতটুকু অধিকার লাভ করে তার উপর ভিত্তি করেই অধিকতর দাবিদাওয়া ও অধিকার আদায়ে সজাগ হয়ে উঠে। তবে এ আইনে বেশ কিছু ত্রুটি আছে তথাপি এ আইন ভারতীয়দের দাবিদাওয়া ও আশা পূরণে সতর্ক করে তুলেছিল

ভূমিকা : ‘স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন' বলতে ১৯৩৫ সালের পাসকৃত ভারত শাসন আইনকে বুঝায়। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের দাবি পূরণের বিভিন্ন আইন পাস করে ভারতীয়দের মন জয় করতে চেষ্টা করেন। ১৯১৯ সালের আইন ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর প্রদান করে ১৯৩৫ সালে একটি আইন পাশ করেন যা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন নামে পরিচিত।
→ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলতে সাধারণত প্রদেশের স্বতন্ত্র বা নিজস্ব শাসনকে বোঝায়। কেন্দ্ৰীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণমুক্ত প্রাদেশিক সরকার প্রাদেশিক বিষয় পরিচালনা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে । এতে দেখা যায় :
১. প্রাদেশিক সরকার প্রাদেশিক প্রশাসন পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ।
২. এখানে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ১৯৩৫ সালের আইনে প্রাদেশিক মন্ত্রীগণ প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য এবং এর কাছে দায়ী থাকেন। প্রাদেশিক গভর্নরকে করা হয় নিয়মতান্ত্রিক শাসক ।

→ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মূলনীতি : নিম্নে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মূলনীতিগুলো তুলে ধরা হলো :
১. আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকার হবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত।

২. প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রদেশের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে মন্ত্রিপরিষদের হাতে এবং মন্ত্রিপরিষদ তাদের কার্যাবলির জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন । প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন ।

৩. আর্থিক ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রদেশ আত্মনির্ভরশীল হবে। জাতীয় সম্পদ, রাজস্ব এবং সরকারের আয়ের উৎস এমনভাবে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। যাতে প্রাদেশিক সরকারের অর্থের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভর করতে না হয় ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর এই আইনের অধীন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ছিল বস্তুনিষ্ঠ। তাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন নামে পরিচিত।

অথবা, ক্রিপস মিশন পরিকল্পনা সম্পর্কে যা জান লিখ।

ভূমিকা : পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায়। কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকারের শাসনামলে ভারতবর্ষে বিভিন্ন দাবিতে অনেক সময় রাজপথ সরব হয় । ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইংল্যান্ড যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভারতবর্ষে মুসলিম লীগের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি এবং কংগ্রেসের স্বাধীন- সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি ভারতবর্ষে একটি সমস্যা সৃষ্টি করে। এ সমস্যার মুখে ব্রিটিশ সরকার সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার জন্য প্রেরণ করেন। স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব ঘোষণা করেন, যা তার নামানুসারে ক্রিপস মিশন নামে পরিচিত ।

→ ক্রিপস প্রস্তাবের পটভূমি : ব্রিটিশ ভারত শাসন যুগে পুরো সময়টাই কোনো কোনো সমস্যায় ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারতবাসীকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তা কার্যকরী না হওয়ায় ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়। আর এর পরবর্তীতে আর এক সমস্যা শুরু হয়। মুসলমানদের পক্ষ থেকে মুসলিম লীগ পৃথক এক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প এবং কংগ্রেস ভারতকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তারা আন্দোলন শুরু হয়। কংগ্রেসের মন্ত্রিসভাগুলোর কার্যকলাপের ফলে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের বিরোধিতা দিনে দিনে আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই সমস্যার সমাধান অতি জরুরি হয়ে পড়ে। এদিকে প্রাদেশিক কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলো ১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে ব্রিটিশ যুদ্ধ নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করে। মুসলিম লীগও এই পদত্যাগে আনন্দ প্রকাশ করে। ‘নাজাত দিবস' উদযাপনের ডাক দেয়। এদিকে এই দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে রামগড় অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। এছাড়া মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব ঘোষণা করে। ফলে সমগ্র ভারতবর্ষে এক নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা ব্রিটিশ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ অবস্থায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ভারতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য মার্শাল চীয়াং কাইশেরকে চাপ দেন। কারণ আমেরিকার ভয় ছিল দ্বিতীয় = মহাযুদ্ধে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মনোভাবের পরিবর্তন না হলে ভারত এশিয়াবাসী হিসেবে জাপানকে সমর্থন করতে পারে। জাপান ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাল হাৎপার আগমন করেন এবং জাপান সৈন্যগণ অতিদ্রুত দূরপ্রাচ্য দখল করে বলা হয় ে ভারতের পূর্ব প্রান্তে উপস্থিত হলে ব্রিটিশ সরকার এ যুদ্ধে হবে। প্রাে ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা প্রত্যাশা একটি নিব করে। ভারতীয় এই সমস্যা মার্কিন সিনেটেও আলোচিত হয়। নির্বাচকম এক পর্যায়ে রুজভেল্ট তার বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক দূত বলা হয়, হ্যরিমানকে এক পর্যায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে ভারতীয় || জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনার কথা বলেন। এই সময় চার্চিল ও মারিমানের মধ্যে এক আলোচনা বৈঠক হয় এবং চার্চিল মিশন প্র ভারতীয় সমস্যাকে সমাধানের অতীত বলে বর্ণনা করেন। দুটো শব্ পরবর্তীতে ৮ই মার্চ রুজভেল্ট পুনরায় চার্চিলের কাছে একবার্তায় বলেন, ভারতীয় সমস্যাকে যুদ্ধজয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ | যদি ন বলে বর্ণনা করেন। অপরদিকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রদেশ ব্রিটেনের শ্রমিক দলও চাপ দেন। তাই সবকিছু বিবেচনা করে ইচ্ছাম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ পার্লামেন্টের এক ঘোষণায় ভারতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য একটি মিশন গঠনের কথা উল্লেখ করেন। এই ঘোষণা অনুসারে, ১৯৪২ সালের ২৩ চুক্তি মার্চ ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতীয় নেতাদের সাথে আলোচনার জন্য কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে ভারতে উপস্থিত হন। তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে বার বার আলোচনায় | ক্রিপা বসার জন্য আহ্বান করেন। কিন্তু তারা আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস তার নিজস্ব স্বাধী পরিকল্পনা জনসম্মুখে প্রচার করেন, যা ইতিহাসে ক্রিপস মিশন প্রস্তাব নামে বিখ্যাত ।

→ ক্রিপস প্রস্তাবের শর্তাবলি : ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ চেষ্ট স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং প্রকাশিত প্রস্তাবসমূহের শর্তাবলি নিম্নরূপ :

১. যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন গঠন : ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশনে পরি বলা হয় যে, ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন হবে এবং যে রা ডোমিনিয়ন গঠন করা হবে তা অন্যান্য ডোমিনিয়নের সমকক্ষ হবে।

২. ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা : ক্রিপস মিশন প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভারতকে পৃথক ডোমিনিয়নের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং যে ডোমিনিয়ন গঠন করা হবে তা অন্যান্য ডোমিনিয়নের সমকক্ষ হবে।

৩. ব্রিটিশ রাজা/রানির কর্তৃত্ব বৃদ্ধি : ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশন পরিকল্পনায় বলা হয় যে, গণপরিষদ কর্তৃক নতুন সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ভারত সরকারের উপর থাকবে। আর সামরিক, নৈতিক ও বস্তুগত সম্পদকে সংগঠতি করার দায়িত্ব ভারত সরকারের উপর ন্যস্ত থাকবে ।

৪. নতুন সংবিধান প্রণয়ন : ক্রিপস মিশনে বলা হয় যে, ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ভারতের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। যে সংবিধানে ভারতবাসীর সকল নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা লিপিবদ্ধ থাকবে।

৫. গণপরিষদ গঠন : ১৯৪২ সালে ক্রিপস মিশন প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে। প্রাদেশিক আইন সভাগুলোর নিম্নকক্ষের সকল সদস্যদের নিয়ে একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হবে। গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা উক্ত ।। নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য সংখ্যার এক-দশামাংশ হবে। এখানে আরো বলা হয়, গণপরিষদে ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

৬. শর্তসাপেক্ষে শাসনতন্ত্র গ্রহণ : ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশন প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকার গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত শাসনতন্ত্র দুটো শর্তে গ্রহণ করবেন । যথা :

(ক) প্রথম শর্তে বলা হয়, ব্রিটিশ ভারতের কোনো প্রদেশ যদি নতুন সংবিধান গ্রহণ করতে অসম্মতি জানায় তবে সে প্রদেশ ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারবে ।
(খ) ব্রিটিশ সরকার ও গণপরিষদের মধ্যে বর্ণগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য একটি চুক্তি সাক্ষরিত হবে ।

→ ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা : নিম্নে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলে ব্রিটিশদের ঔদাসিক মনোভাব : ক্রিপস মিশন ব্যর্থতার জন্য ব্রিটিশ, সরকারের ঔদাসিক মনোভাবকে অনেকাংশে দায়ী করা যায়। কারণ ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে ব্রিটিশ সরকার কখনো ইচ্ছুক ছিল না। আর ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ছিল ধূর্তবাজ। তাই তিনি ভারতবাসীকে আশার বাণী শুনিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করেন, ফলে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয় ।

১. ভারতে অনুপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ : ক্রিপস মিশন পরিকল্পনা যখন পাস হয় তখন ভারতে এক অনুপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। অর্থাৎ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে। ব্রিটেনের চার্চিলের ঘোষণা ও ভারতীয়দের মনে বিরূপ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ঘোষণা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এরূপ বৈরি পরিবেশে এরকম শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।

২. কংগ্রেসের মনোভাব : কংগ্রেসের বিরূপ মনোভাব ও এই মন্ত্রিমিশন পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী ছিল। দেশ রক্ষা বিভাগ ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
(ক) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সংবিধান কার্যকর রাখার প্রস্তাবও কংগ্রেসের মনঃপূত হয়নি।
(খ) অবিলম্বে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রদানের কথা এ প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল না ।
(গ) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা কংগ্রেসের আশানুরূপ হয়নি।

৩. মুসলীম লীগের মনোভাব : বলা চলে মুসলিম লীগের মনোভাবও ক্রিপস মিশন প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী ছিল ।
(ক) বর্ণ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে কোনো স্পষ্ট প্রস্তাব ছিল না ।
(খ) এ প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তান দাবি মেনে নেওয়া হয়নি । (গ) মুসলমানদের নিয়ে পৃথক গণপরিষদ গঠনের কথাও উক্ত-প্রস্তাবে গৃহীত হয়নি

উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে বিরাজমান সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যই ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকারের পদক্ষেপ হিসেবে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাব ভারতবাসীর জন্য একেধারে অমঙ্গলজনক ছিল না। কিন্তু মুসিলিম লীগ ও কংগ্রেসের অসহযোগিতায় এ প্রস্তাব কার্যকর হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তথাপি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ প্রস্তাবের গুরুত্ব কম নয় ।

ভূমিকা : চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইন হলো ব্রিটিশ সরকারের সাথে কোম্পানির চুক্তি। কোম্পানি কর্মচারীদের দুর্নীতি অভিযোগের প্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম ১৭৯৩ সালে সনদ আইন পাস হয়। ১৭৯৩ সালের সনদ আইনের ২০ বছর পূর্ত হলে ১৮১৩ সনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পুনরায় সনদ আইনের দাবি উঠে। ফলে ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ২য় সনদ আইন পাস হয় ।

→ ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের ধারাসমূহ : নিম্নে ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের ধারাসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. কোম্পানির ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণ : কোম্পানির ক্ষমতা ও অধিকার আগের মতোই রাখা হয় ১৮৫৩ সালের সনদ আইনে। তবে এই সনদটি ২০ বছরের জন্য মঞ্জুর করা হয়নি। কোম্পানিকে ভারতীয় সাম্রাজ্যে শাসন করার অধিকার দেওয়া হয় । সনদে ইংল্যান্ডের রানি ও তার উত্তরাধিকারীদের অনুকূলে । কোম্পানি শাসন ভারতে ততদিন বহাল থাকবে যতদিন পর্যন্ত পার্লামেন্টে অন্য ব্যবস্থা না হয় ।

২. বেতন সংক্রান্ত : এই আইনে বলা হয়েছে যে, Board of control-এর সদস্যদের এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বেতন দিবে কোম্পানি। রাজা কর্তৃক তাদের বেতন নির্ধারিত হবে। আইনে আরো বলা হয় রাষ্ট্র সচিবের বেতনের চেয়ে বোর্ড সভাপতির বেতন কম হবে না। পূর্বের বেতন সংক্রান্ত সব আইন বাতিল করা হয় ১৮৩৩ সালের সনদ আইনে ।

৩. ডাইরেক্টর সভার ক্ষমতা হ্রাস : পূর্বে ডাইরেক্টর সভা কোম্পনির জন্য প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগ করবে। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনে ডাইরেক্টর সভার ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। Board of control-এর মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। লর্ড মেকলের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দায়িত্ব দেওয়া হবে এই কাজ সম্পাদনের জন্য ।

৪. লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পদ সৃষ্টি : বাংলার গভর্নরের দায়িত্ব পূর্বে ছিল গভর্নর জেনারেলের উপরে। এতে করে গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। তাই গভর্নর হেনারেলের উপর কাজের চাপ কমাতে তাকে বাংলার গভর্নর এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যার জন্য গভর্নর জেনারেলের জায়গায় নতুন পদ লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদ সৃষ্টি করা হয়।

৫. গভর্নর জেনারেলের পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ১৮৩৩ সালের সনদে গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩ জন। ১৮৫৩ সালের সনদ আইনে গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়। ৪ জন সদস্য করা হয় শাসন পরিষদে। এর সাথে গভর্নর জেনারেলের আইন পরিষদকে স্থায়ী করা হয় ।

৬. গভর্নর জেনারেলের কার্যাবলি পৃথক : ১৮৫৩ সালের সনদ আইনে প্রথমবারের মতো গভর্নর জেনারেলের পরিষদের আইন ও প্রশাসনিক কাজকর্ম পৃথক করা হয়। গভর্নর জেনারেলের আইন পরিষদ গঠিত হয় ১২ জন সদস্য নিয়ে। ৭ জন উপস্থিত হলে কাজ করা যাবে। গভর্নর জেনারেল পরিষদের বিলে সম্মতি প্রদান না করলে তা আইনে পরিণত হতো না। এইগুলো আইন হতো তার অনুমতিতে।

৭. আইন পরিষদের কার্যাবলি : এই আইনে আইন পরিষদের কার্যাবলি নির্দিষ্ট করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতোই ছিল আইন পরিষদের কার্যাবলি। পরিষদের সদস্যদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা ও সরকারের নীতির উপর আলোচনা করা ছিল আইন পরিষদের কার্যাবলি। আইন পরিষদের পরামর্শ বড়লাট ইচ্ছা করলে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারতো।

৮. নতুন প্রদেশ গঠন : ডাইরেক্টর সভাকে নতুন প্রদেশ গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ডাইরেক্টর সভা নতুন যে প্রদেশ গঠন করবে এগুলোর সীমানা ও নির্ধারণ করবে। এছাড়া দরকার হলে নতুন প্রদেশগুলোর সীমারেখা পরিবর্তন করা যাবে। ডাইরেক্টর সভা ১৮৫৯ সালে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে পাঞ্জাব প্রদেশ গঠন করে।

৯. আইন কমিশন গঠন : ইংল্যান্ডের রাজাকে বলা হয় একটি পরিষদ গঠন করতে। এই আইন কমিশন ভারতীয় আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন আইনে খসড়া প্রস্তুত করবে। একই সাথে কী আইন প্রণয়ন করা যায় তার সুপারিশ প্রদান করবে। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধি আইনে পরিণত হয় ।

১৮৫৩ সালের সনদ আইনের সাংবিধানিক গুরুত্ব : নিচে ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের সাংবিধানিক গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাবসান : ১৭৭৩ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসনের সনদ ২০ বছর করে নবায়ন করলেও ১৮৫৩ সালে এসে কোম্পানির শাসনের সনদ নবায়ন করেনি, বরং ব্রিটিশ ভারতকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে রেখে কোম্পানিকে শাসন করার অধিকার দেওয়া হয়। যেখানে কোনো সীমারেখা ছিল না। বলা হয় পার্লামেন্টের পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত কোম্পানির শাসন বহাল থাকবে।

২. ভারতে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার প্রচলন : ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে পার্লামেন্টারি শাসন ও আইন ব্যবস্থার প্রচলনের ব্যবস্থা করেন। এজন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় ডাইরেক্টর সভার সদস্য কমিয়ে ১৮ জন করেন এবং এর মধ্যে ৬ জন রাজা কর্তৃক মনোনয়নের ব্যবস্থা করা হয় ৷

৩. ডাইরেক্টর সভার ক্ষমতা : এ আইনের মাধ্যমে কোম্পানিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে ডাইরেক্টর সভার ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। এ সময় লোক নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয় বোর্ড অব কন্ট্রোলের অধীনে। সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগের ক্ষমতা ও ডাইরেক্টর সভার কাছ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। যা এ সভার সার্বিক ক্ষমতাকে খর্ব করে ।

৪. আইন কমিশন গঠন : ১৮৫৩ সালের আইন অনুযায়ী . ব্রিটেনে আইন কমিশন গঠন করা হয়। ভারতের আইন কমিশনের সুপারিশ, অভিযোগ, তথ্য বিবেচনা ইত্যাদির জন্য এ কমিশন গঠিত হয়। যা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম পদক্ষেপ।
নিয়ন্ত্রণকারী পরিষদের সভাপতিকে ব্রিটেন এর রাষ্ট্রীয় সচিব এর ৫. বোর্ড সভাপতির মর্যাদা বৃদ্ধি : এ আইনের মাধ্যমে সমমর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদান করা হয়। যার ফলে ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায় ।

৬. প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন : ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। যার সূচনা হয় বাংলায় একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগের মধ্য দিয়ে। এর ফলে বাংলার উপর গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং বাংলাকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর এর নিয়ন্ত্রণে প্রদান করা হয়। এর ফলে বাংলার জন্য পৃথক স্থায়ী সরকার গঠিত হয়।

৭. শাসন বিভাগে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের সূচনা : ১৮৫৩ সালের আইনে ‘স্থানীয় প্রতিনিধিত্বে নীতি' গ্রহণ করা হয় । যার মাধ্যমে ভারতের লোকদেরকে স্থানীয় প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া পরিকল্পনা গৃহীত হয়। গভর্নর জেনারেলের নিয়ন্ত্রণাধীন আইন পরিষদে প্রদেশসমূহের বিচারপতি, কর্জ ও প্রদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের স্থান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ এ আইনের মাধ্যমে গভর্নর জেনারেলের আইন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে পৃথকীকরণ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি করা হয়।

৮. যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি : ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়দের সরকারি চাকরি প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। অর্থাৎ যোগ্যতার ভিত্তিতে সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও সম্প্রদায়ের। লোকেরা সরকারি চাকরি পাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও এর বাস্তবায়ন জোরালোভাবে ঘটেনি তবুও এর গুরুত্ব অনেক।

উপসংহার : সার্বিক আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৮৫৩ সালের সনদ আইন এর মধ্য দিয়ে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চূড়ান্ত বিলোপ ঘটে। যা ১৮৫৮ সালে আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করে ।

অথবা, ১৭৯৩ সালের সনদ আইনের পটভূমি বর্ণনা কর।

ভূমিকা : ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। এতে করে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত হয় । একই সাথে তারা রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় শুরু করে। তবে কোম্পানির কর্মচারীরা এসময় ব্যাপকহারে দুর্নীতি ও কুশাসন শুরু করে দেয়। এতে করে ব্রিটিশ সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থ ভালোভাবে পূরণ করতে পারছে না। যার জন্য ১৭৭২ সালে নিজ হাতে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। তবুও কর্মচারীদের দুর্নীতি ও কুশাসন কমেনি। তাই ব্রিটিশ সরকারে পুরাতন নীতির পরিবর্তন করে। অবশেষে ভারতের ইতিহাসে ১৭৯৩ সালে। ব্রিটিশ সরকার প্রথম সনদ আইন প্রবর্তন করেন।

→ ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনের প্রেক্ষাপট : বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানি ক্ষমতা কোম্পানি নিলেও সরকার তেমন নিয়োগ লাভবান হয়নি। এজন্য ১৭৭৩ সালে কোম্পানিকে ২০ বছরের জন্য রেগুলেটিং অ্যাক্ট কোম্পানিকে বাণিজ্য সংক্রান্ত ধারণা নিয়োে দেওয়া হয়। তাই পার্লামেন্টে কোম্পানির সকল কিছু নবায়নের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তখন ভারতবর্ষের জন্য কোম্পানিকে চার্টার আইন প্রদান করা হয়। ১৭৭২ খ্রি. কোম্পানি নিজ হাতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনভার গ্রহণ করলেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন না ঘটায় ব্রিটিশ সরকার তার কোম্পানির নীতির পরিবর্তন ঘটায়। আর এ সূত্র ধরে কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট | Bo ১৭৯৩ সালে যে সনদ আইন প্রবর্তন করেন তাই ভারতের ইতিহাসে প্রথম সনদ আইন।

→ ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনের বৈশিষ্ট্য/ধারাগুলো : ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধারা প্রবর্তন করা হয়। যা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক পাস হয়। নিম্নে ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনের ধ
১. গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের ক্ষমতা : ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরদেরকে তাদের পরিষদের মতামত অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। অর্থাৎ গভর্নর জেনারেল পরিষদের উপরে কথা বলতে পারবে। বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশকে
১৭৮৬ সালের আইনে এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয় ।

২. গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বৃদ্ধি : গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় ১৭৯৩ সালের আইনে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্টির এর সাথে গভর্নর জেনারেলকে মাদ্রাজ ও বোম্বাই পরিষদে সভাপতিত্ব করার অধিকার দেওয়া হয়। কোম্পানির যেকোনো কর্মচারীর উপর গভর্নর জেনারেল আদেশ জারি করতে পারবে। গভর্নর জেনারেলকে প্রেসিডেন্টির সব বিশেষ কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।

৩. সহ-সভাপতি নিয়োগ : গভর্নর জেনারেল অনেক সময় বাংলা প্রেসিডেন্সির বাহিরে গেলে তার অনুপস্থিতিতে একজন সহ-সভাপতি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর এই সহ- সভাপতি গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করবে। গভর্নর জেনারেল তার পরিষদ থেকে সহ-সভাপতি নিয়োগ করতে পারবেন।

৪. ডাইরেক্টর সভার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : এই আইনে বলা হয়েছে যে, ডাইরেক্টর সভার অনুমতি ছাড়া গভর্নর জেনারেল, গভর্নর, প্রধান সেনাপতি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ভারতের বাহিরে যেতে পারবে না। একই সাথে তারা যখন ভারতের বাইরে থাকবেন তখন তাদের জন্য অনুপস্থিত ছুটি মঞ্জুর করা হবে না। কোনো কর্মকর্তা অনুমতি ছাড়া ভারতের বাহিরে গেলে তিনি পদচ্যুত হবেন ।

৫. বিচারক নিয়োগ : ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে বিকার নিয়োগ করতে বলা হয়। কেননা প্রেসিডেন্সিগুলো শান্তি বজায় রাখতে গভর্নর জেনারেল ও পরিষদকে ইংল্যান্ডে রাজার নামে বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ কর্মচারী বা ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে থেকে বিচারক নিয়োগ করতে হবে ।

৬. Board of Control-এর সদস্যদের বেতন নির্ধারণ : Board of Control-এর সদস্যদের কোনো বেতন দেওয়া হতো না। ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে Board of Control-এর সদস্যদের জন্য বেতন নির্ধারণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদেরকে বেতন দেওয়া হবে ভারতের রাজস্ব থেকে। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা টিকে ছিল। বেতন নির্ধারণ করাতে Board of Control এর সদস্যদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায় ।

৭. অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ : ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে কোম্পানির অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১২ লক্ষ ৩৯ হাজার ২৪১ পাউন্ড কোম্পানির রাজস্ব উদ্বৃত্ত ধরা হয়। এই রাজস্বের মধ্যে কোম্পানির ঋণ পরিশোধের জন্য ৫ লক্ষ পাউন্ড দেওয়া হয়। এর সাথে ৫ লক্ষ পাউন্ড ব্যবসায়ের লভ্যাংশ হিসেবে কোম্পানিকে দেওয়া হয়।

৮. ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া : ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয় ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যা ব্যবসায়ীদের অনুকূলে ছিল না । তাই তারা শেষ পর্যন্ত এই সুযোগ গ্রহণে উৎসাহ দেখায়নি। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা তেমন সুবিধা লাভ করেনি।

৯. কর্মচারীদের পদমর্যাদা নির্ধারণ ও নিয়োগ পদ্ধতি : ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে কোম্পানির সিনিয়র লোকদের বেশি ে পদমর্যাদা প্রদান করা হয়। কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজের ভিত্তিতে উচ্চপদে প্রতিশ্রুতির ব্যবস্থা করা হবে। আর ে কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হবে কোনো প্রেসিডেন্সিতে পদ খালি হলে। এতে করে শূন্য পদ পূরণ হয়ে যাবে।

মূল্যায়ন : ১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে আগের অনেক আইন বাতিল করে নতুন আইন চালু করা হয়। এ প্রসঙ্গে A.B. Keith বলেছেন, "It was essentially a consolidating measure andits altercation stnck at points of detail.' Dr. Banerjee বলেছেন, "No great consitutional change was introduced by this statute of consolidaration." এই আইনের কিছু সমালোচনা করা হয়। যেমন ব্যবসায়ীদেরকে সুযোগ | প্রদান করার প্রয়োজন ছিল না।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ইস্ট ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালের চার্টার আইন প্রণয়ন করেন। যদিও এটি সব উদ্দেশ্যে পূরণ করতে পারেনি। তবুও অনেকাংশেই এই আইনের ধারাগুলো সফল হয়েছিল। যা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অন্যতম একটি সফলতা। এটি ছিল ব্রিশি সরকারের অন্যতম একটি পদক্ষেপ। যার জন্য কোম্পানির দুর্নীতি ও কুশাসন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল |

ভূমিকা : ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের জয়ের মাধ্যমে ইংরেজরা যে শাসন প্রতিষ্ঠা করে ভারতবাসী ছিল এর বিরুদ্ধে। তখন থেকে চলমান নানা সাংবিধানিক ও সশস্ত্র আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ শাসন নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল। তাই বলা যায় ভারত বিভাজন এক প্রকার অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল ।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন অপরিহার্য ছিল কি না: নিম্নে পর্যায়গুলোর আলোকে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি যে অনিবার্য ছিল বর্ণনা করা হলো :

১. ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ : ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ছিল ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী প্রথম জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন। এর প্রেক্ষিতে ইংরেজরা ভারতে নিজেদের ভারতবর্ষে ব্রিটিশ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে।

২. সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন : ১৮৮৬ সালের ভারতীয় শাসন এর অ জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলন, ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ গঠন প্রভৃতি ছিল ভারতীয় সুপারিশ করে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনবিরোধী গঠনমূলক রাজনৈতিক আন্দোলন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশ সরকারের নানা বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় যা ব্রিটিশ সরকারকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলে ।

৩. স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলন : ১৯০৫ সালের বঙ্গবঙ্গের বিরোধিতায় স্বদেশী আন্দোলন এবং ১৯১৯ সালের রাওলাট অ্যাক্টের | করতেন। ব বিরোধিতায় অসহযোগী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তদুপরি খেলাফত থেকেই অ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ভারত ছাড় আন্দোলনের মতো বিরুদ্ধে অ সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবাসী ইংরেজ শাসনের প্রতি সালে যে তাদের তীব্র অনীহা প্রকাশ করে। এসব আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ | প্রতিষ্ঠার সরকার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রমাদ গুণে ।

৪. ১৯৩৭ সালের নির্বাচন ও লাহোর প্রস্তাব : ১৯৩৭ সালের প্রথম প্রদেশগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তদুপরি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে জোর দাবি উঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির ক্ষেত্রে আড়ালে ভারতীয় স্বাধীনতার দাবি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে ।

৫. ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন সংস্কার আইন : ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন, ১৮৬১ ও ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৯০৯ ও ১৯১৯ সালের সংস্কার আইন, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রভৃতি আইনের ধারাবাহিকত।ই ছিল ১৯৪৭ সালের ‘ভারত স্বাধীনতা আইন ।

৬. ১৯৪৬ সালের নির্বাচন ও বিভিন্ন পরিকল্পনা : ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। তদুপরি, ১৯৩৯ সালের জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ও মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভক্তি সুস্পষ্ট হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইংরেজ শাসন পত্তনের সময় থেকেই ভারতবাসীর মনে যে বিরোধিতা দেখা দেয় তা পরে চরম রূপ লাভ করে। এই বিরোধিতা এবং হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কথা মাথায় রেখেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩ জুন ১৯৪৭ সালে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনার আলোকেই ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত স্বাধীনতা আইন পাস হয়। এই আইনের আলোকে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। তাই প্রেক্ষাপট আলোচনা সাপেক্ষে বলা যায় ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি ছিল অপরিহার্য।

অথবা, ১৯৪৬ সালের কেবিনেট মিশন সাংবিধানিক ব্যবস্থার জন্য যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল তা বর্ণনা কর ।

ভূমিকা ভূমিকা : ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই ভারতীয়রা তাদের প্রতি অসন্তোষ ছিল এবং প্রথম থেকেই নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে আসছিল। পরবর্তীতে এ আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন ব্রিটিশ সরকার এর স্থায়ী সমাধানের ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার তিনজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে ভারতবর্ষে প্রেরণ করেন। এ মিশন ভারতে এসে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাথে বৈঠক করেন তবে তারা ঐক্যমত্যে পৌছাতে পারেননি। যার কারণে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানিক রূপরেখা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। পরবর্তীতে এ মিশন নিজেরাই এর সমাধানের জন্য পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এটাই কেবিনেট মিশন বা মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা বলে পরিচিত।

→ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রস্তাবসমূহ : এটি ছিল ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব পরিকল্পনা। তাদের এ পরিকল্পনার ধারা বা প্রস্তাবসমূহ নিম্নরূপ

১. ভারতীয় ইউনিয়ন : ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে ভারতবর্ষে একটি ভারতীয় ইউনিয়ন গঠিত হবে বলে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনাতে উল্লেখ করা হয়। যেই ইউনিয়নে কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালনার ভার অর্পিত থাকবে। সেইসাথে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য অর্থসংগ্রহের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। আর এই ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন ছিল মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রধান একটা প্রস্তাব ।

২. দেশীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় বলা হয় যে, দেশরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক ছাড়া বাকি বিষয়গুলো প্রাদেশিক ও দেশীয় রাজ্য সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকবে ।

৩. গ্রুপি ব্যবস্থা : মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় রাজ্যগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা ‘ক’ গ্রুপে মধ্যপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ ও মুম্বাই এ ৬টি প্রদেশ ও উত্তর সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, পাঞ্জাব এ তিনটি প্রদেশ মিলে ‘খ’ গ্রুপ এবং বাংলা ও আসাম মিলে গ' গ্রুপ করা হয় এবং প্রত্যেকটি গ্রুপ স্বতন্ত্র সরকার গঠন ও সংবিধান রচনা করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়।

৪. ভারতীয় ইউনিয়নের আইন ও শাসন বিভাগ : ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশসমূহের ও দেশীয় রাজ্যসমূহের সমন্বয়ে যে ইউনিয়ন গঠন হবে বলে উল্লেখ করা হয় সেখানে উক্ত ইউনিয়নের আইন ও শাসন বিভাগ থাকবে এবং যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

৫. সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ : আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্য বা প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ভারতীয় ইউনিয়ন গণপরিষদ বা সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ গঠিত হবে। আর এ পরিষদই ভারতীয় ইউনিয়নের সংবিধান রচনা করবে।

৬. গ্রুপ সরকারের বৈশিষ্ট্য : মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় যে গ্রুপিং ব্যবস্থা করা হয় তার প্রত্যেক গ্রুপে একটি আইনসভা ও শাসন বিভাগ থাকবে এবং শাসনতন্ত্রে কি কি বিষয় থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়।

৭. দেশীয় রাজ্যের মর্যাদা : ভারতীয় ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর দেশীয় রাজ্যের উপর ব্রিটিশদের ক্ষমতার অবসান তথা দেশীয় রাজ্যের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায় এবং প্রত্যেক রাজ্য স্বাধীনভাবে চলতে শুরু করে।

৮. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে গভর্নর জেনারেল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয় যা সংবিধান রচনা পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

৯. রাজ্যগুলোর ক্ষমতা : মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় গঠিত গ্রুপিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গঠিত প্রদেশগুলো আইনসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেকোনো প্রদেশ তার গ্রুপ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। যেখানে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হয়।

১০. গণপরিষদ গঠন : গণপরিষদ গঠন পদ্ধতির ব্যাপারে জনসংখ্যানীতি গ্রহণ করে এ পরিকল্পনা গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের জনগণ পরিষদ গঠনের গঠনের ব্যবস্থা করা হয় ৷

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় ভারতীয়দের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করে। এ পরিকল্পনায় বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি হিন্দু ও মুসলিম লীগের পারস্পরিক আস্থাহীনতা প্রভৃতির কারণে শেষ পর্যন্ত এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং ভারত বিভক্তির পথ সুগম হয়। যার কারণে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ছিল ভারতের ইতিহাসে অনন্য অধ্যায় ৷

অথবা, সিমলা ডেপুটেশন সম্পর্কে কি জান?

ভূমিকা : ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। তবে ভারতীয় হিন্দুরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানায় এবং সমাজে নিজেদের স্থান করে নিতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে দেখা যায়, সকল দিক থেকে ভারতীয় হিন্দুরা স্থান করে নেয় এবং মুসলমানরা অবহেলিত বলে পরিগণিত হয়। হিন্দুদের সংগঠন বলে খ্যাত কংগ্রেস প্রথম পর্যায়ে ছিল অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। কিন্তু পরে কংগ্রেসের কয়েকজন উগ্রপন্থি নেতার জন্য তা সাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। তাই ভারতীয় মুসলমানরা নিজেদের একটি কথা বলার মাধ্যম তৈরি করার জন্য প্রচেষ্টা চালান।

সিমলা ডেপুটেশন : ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিয়ে লর্ড মলির → ঘোষণায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা জানতে পেরে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ তাদের মতে, ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা গঠিত হলে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে, তাই নতুন শাসনতন্ত্রে মুসলমানরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বড়লাট মিন্টোর কাছে প্রতিনিধি দল পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই মহসিন-উল-মূলক কাল বিলম্ব না করে বড়লাট লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাতের জন্য একটি প্রতিনিধি দল গঠন করেন। এছাড়া আলীগড়ের অধ্যক্ষ Archibold এর সহযোগিতায় একটি স্মারকলিপি রচনা করেন। মহামান্য তৃতীয় আগা খানকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর আগা খানের নৃেতত্বে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল সিমলায় বড়লাট মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। যা ইতিহাসে সিমলা ডেপুটেশন নামে খ্যাত ৷

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমানদের স্বার্থগত বিচারে সিমলা ডেপুটেশনকে এক মাইলফলক বলা যায়। কারণ এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুসলমানরা দীর্ঘদিন থেকে তাদের যে বৈষম্যের পাহাড় এর অভিজ্ঞতা তা তুলে ধরে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের পথ সুগম করতে সক্ষম হন।

অথবা, ইলবার্ট বিল আইন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

ভূমিকা : লর্ড রিপন ছিলেন একজন উদার, আন্তরিক ও সহানুভূতি সম্পন্ন মানুষ। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে তিনি তার শাসনকালে নানাবিধ সংস্কার ও আইন প্রণয়নের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার শাসনামলে তিনি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন এবং নতুন নতুন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তার রাজত্বকালের অন্যতম কীর্তি হলো ইলবার্ট বিল নামে একটি আইন প্রণয়ন করা। তার এ কীর্তি তৎকালীন সময়ে কতটুকু ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো :

ইলবার্ট বিল : লর্ড রিপন তার শাসনামলে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন এবং নতুন নতুন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তার শাসনকালীন সময়ের অন্যতম কীর্তি হলো ইলবার্ট বিল নামে একটি আইনের পরিকল্পনা। এ বিলের উদ্দেশ্য ছিল বিচার ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে যে বৈষম্য ছিল তা দূর করা । লর্ড রিপন বিচার বিভাগের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সচিব ইলবার্টকে একটি বিল প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। যার কারণে স্যার ইলবার্ট এর নামানুসারে এ বিলটি ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত। এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে ভারতের বিলে ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়। এ বিলটি ১৮৮৩ সালে পাস হয়। ইলবার্ট বিল ছিল ভারতীয় রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এ বিলকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের মনোভাবের প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতি প্রসারিত হয়েছিল। এ ঘটনার ফলে ভারতের শিক্ষিত সমাজ বুঝতে পারে ভারতবাসীকে তার নিজ অধিকার নিজেদেরকেই অর্পণ করতে হবে। এ সম্পর্কে এ এম বুচ বলেন যে, ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন ভারতীয়দের তিনটি শিক্ষা দিয়েছিল-বর্ণগত উদ্ধত বিরাজমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী বাস্তবতা সকল সংগঠন আশ্চর্যজনক ফল বয়ে আনতে পারে : আর আইন বলে সরকারকে ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে অমান্য করা যেতে পারে ৷

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘদিনের বিচার সংক্রান্ত যে জটিলতা বিরাজ করছিল এ বিলের মাধ্যমে তার অনেকটাই দূর হয়েছিল। তাছাড়া ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় জাগ্ৰত | করার ক্ষেত্রে ইলবার্ট বিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তাই | বলা যায়, এটা নিঃসন্দেহে লর্ড রিপনের অনন্য কীর্তি ।

ভূমিকা : ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে ভারতের নানা ধরনের উন্নয়ন ও কল্যাণের কথা বললেও তা করা হয়নি, বরং নানা ধরনের অনিয়ম, অত্যাচার, শোষণ, ঘৃণা ও বৈষম্য শুরু হয়। এসব বিষয় যখন ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে তখন ব্রিটিশ সরকার ভারতে সংবাদ পত্র আইন বা Vernacular Press Act নামে একটি আইন পাস করে।
ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৭৮ : ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা, বৈষম্যমূলক আচরণ, শোষণ ইত্যাদি ধীরে ধীরে প্রকাশ। হতে থাকে। রেল, স্টিমার, হোটেল, খেলার মাঠ, ক্লাব, রাজপথ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থানে ভারতীয় এবং ইংরেজদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রকাশ ঘটে। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ বিবেচনায় ভারতীয়রা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপমান ও লাঞ্ছনার স্বীকার হতে থাকে। পাশাপাশি ভারতে ব্রিটিশ পণ্যের বাজারে পরিণত করা হয় এবং ভারতীয় কাঁচামাল ব্রিটেনে পাচার করা শুরু হয়। এছাড়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও বৈষম্য করা হয়। আর এ বৈষম্য পুঞ্জীভূত হয়ে ধীরে ধীরে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, নাটক ইত্যাদিতে প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট পাস করেন। বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচার প্রচারণা রোধের জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ সরকারের অনিয়ম, অত্যাচার, বৈষম্য ও শোষণ যখন চরম পর্যায়ে চলে আসে তখন বিভিন্ন সংবাদপত্র, যেমন- সোমপ্রকাশ, সুলভ সমাচার হালিশহর পত্রিকা, ভারত মিহির, অমৃতবাজার পত্রিকা, ঢাকা প্রকাশ ইত্যাদিতে তা প্রকাশিত হতে থাকে। তাই ভাইসরয় লর্ড রিপন ১৮৭৮ সালের ১৪ মার্চ ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট পাস করান। এর মাধ্যমে পত্রিকাগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণাকে রাজদ্রোহ বলে অভিযোগ করা হয় । লর্ড লিটন দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রকে কুচক্রী বাজে লেখকদের প্রকাশ্য রাজদ্রোহী প্রচারণা” বলে অভিযুক্ত করেন। এ আইনে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেমন-

১. সরকার বিরোধ কোনোপ্রকার খবর বা লেখনী সংবাদপত্রে আওতায় আনা হবে। প্রকাশ করা যাবে না। এর জন্য সম্পাদককে ও আইনের মোকদ্দমা ছাড়াই শাস্তি দেওয়া হবে ।
২. বিদ্রোহাত্মক ও সরকারি বিরোধী লেখার অপরাধে মামলা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে বুদ্ধিজীবী মহল এর তীব্র সমালোচনা করে এবং এ আইনকে ‘শ্বাসরোধ আইন' বলে অবহিত করে। এ আইনের ফলে বাংলায় প্রকাশিত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা' ইংরেজিতে প্রকাশিত হতে থাকে এবং দ্বারকানাথ বিদ্যাকৃষণ ‘সোমপ্রকাশ' পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। ‘সন্ধ্যা' পত্রিকার সম্পাদক এ আইন লঙ্ঘন করলে তাকে বিচারের আওতায় নিলে তিনি নির্ভীক কণ্ঠে বলেন যে, ভারতীয় অভিযুক্তদের বিচারের এক্তিয়ার বিদেশি বিচারকদের নেই।

উপসংহার : সার্বিক আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে,ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট প্রেস অ্যাক্ট লর্ড রিপন-এর সময়ে সবচেয়ে সমালোচিত একটি আইন। যার মাধ্যমে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয় এবং বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়। সকল সম্প্রদায়ের লোক এ আইনের প্রতি তীব্র নিন্দা করেন এবং এ আইনকে অবৈধ ও অযৌক্তিক বলে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি চলতে থাকে। তাই শেষ পর্যায়ে লর্ড রিপন এ আইনকে প্রত্যাহার করে নেন ।

The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nulibrary.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram